ঢাকারবিবার , ৭ নভেম্বর ২০২১
  1. Bangla
  2. chomoknews
  3. English
  4. অপরাধ
  5. অভিনন্দন
  6. আমাদের তথ্য
  7. কবিতা
  8. কর্পরেট
  9. কাব্য বিলাস
  10. কৃষি সংবাদ
  11. খুলনা
  12. খোলামত
  13. গল্প
  14. গাইড
  15. গ্রামবাংলার খবর
আজকের সর্বশেষ

আমার বাবা কামাল শাহ বড় বিদ্যাওয়ালা সাধক ছিলেন : জাকিয়া বেগম

admin
নভেম্বর ৭, ২০২১ ১:২৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

একান্ত সাক্ষাতে বাউল কামাল কন্যা জাকিয়া বেগম : আমার বাবা কামাল শাহ বড় বিদ্যাওয়ালা সাধক ছিলেন

আল-হেলাল,সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : বৃহত্তর সিলেটে পালাগানের (মালজুড়া) প্রথম প্রবক্তা,সুনামগঞ্জ জেলার ৫ প্রধান লোককবির মধ্যমনি গানের সম্রাট বাউল কবি কামাল উদ্দিন (কামাল পাশা) এর একমাত্র জীবিত কন্যা জাকিয়া বেগম,তাঁর পিতাকে মরণোত্তর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

তিনি বলেছেন,আমি যখন ৮/৯ বছরের কিশোরী তখন দেখেছি আমার বাবা কামাল পাশার শিয়রে বসে সাধক উকিল মুন্সী গান লিখে নিচ্ছেন। আমার বাবা গানের কথা বলে ও গেয়ে যাচ্ছেন আর উকিল মুন্সী খাতায় গান নোট করছেন। সর্বশেষ ছাতকের শিবপুরের গিয়াস উদ্দিনকেও দেখেছি আমাদের বাড়ীতে আমার বাবার কাছ থেকে গান লিখে নিতে ও গানের পান্ডুলিপি গ্রহন করতে।

মানুষ গান লিখে নিচ্ছে আবার গানের খাতাও দিয়ে দিচ্ছেন এসব ব্যাপারে আমি বাবাকে নিষেধবাধা দিলে তিনি বলতেন নেউকনা অসুবিধা কি ? আমি যা দিচ্ছি তা ফেরত না পেলেও অসুবিধা নেই। কারণ এসব গানগুলো আমার মুখস্থ আছে। এগুলো আমি নিজে রচনা করেছি অসুবিধা নেই। আমি যতদিন আছি ততদিন গান আছে সুর আছে। যেখানে গুড় সেখানেই পিপড়া।

আমিতো দেশে দেশে গান গাই,গান গেয়ে বেড়াই। যারা গানপাগল তারাতো আমার কাছে আসবেই। গত ৩০ অক্টোবর শনিবার বিকেল ২টায় সিলেটের বাগবাড়ী এলাকাধীন ভাড়াটে বাসভবনে এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহনের সময় বিশিষ্ট লোকগীতি গবেষক মাটির তারের গান গ্রন্থের সম্পাদক সৈয়দা আঁখি হক,বাউল কামাল পাশার দৌহিত্র শাকির আহমদ, বাউল গীতিকার মোঃ আলাউদ্দিন,ভাটিপাড়া গ্রামের বাউল শিল্পী ছালেহ আহমদ ও কছবির আহমদ ফাহিম উপস্থিত ছিলেন।

মায়ের নামটি তহুরা বেগম উল্লেখ করে জাকিয়া বেগম বলেন,আমার মা আমার চাইতেও সুন্দর ছিলেন। তিনি আমার বাবার দ্বিতীয় সহধর্মীনি ছিলেন। আমি আমার মা-বাবার একমাত্র কন্যা। আমার বাবার প্রথম স্ত্রী যার ডাকনাম ছিল রাবিয়া খাতুন (কার্ফুলের মা)।

তিনি আমার বাবার প্রথম স্ত্রী ও আমার মায়ের বয়সে বড় ছিলেন। তিনি আমার বাবার মামাতো বোন ছিলেন। আমার মা ও খালা তারা দুই সতীন পরস্পরের বোন সম্পর্কের ঘনিষ্ট আত্মীয় ছিলেন। আমার বড় মায়ের একমাত্র মেয়ে শাফিয়া খাতুন এবং আমাদের দুই মা আমার বাবার মৃত্যুর আগেই মারা যান।

তিনি বলেন,আমার দাদা মরমী কবি আজিম উদ্দিন টিয়ারবাপও কবি ছিলেন। তিনিও গান লিখতেন। কিন্তু সংসার ছেড়ে একেবারে বৈরাগ্যবাদী বাউল হওয়ার পক্ষপাতি ছিলেননা তিনি। মরমী কবি আজিম উদ্দিন বৃটিশ শাসিত আসাম প্রাদেশিক পরিষদের এমপি ভাটিপাড়ার বিখ্যাত জমিদার খান বাহাদুর গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর এপিএস ছিলেন। তিনি কলকাতা শিলং গিয়েছেন।

তাঁর সাথে তার পুত্র কামাল পাশাও নিয়মিত কলকাতা যেতেন আসতেন। আমার দাদার যথেষ্ট বেসাত সম্পত্তি ছিল। তবে আমার বাবা তাঁর বাবার বেসাত ছাইড়া দিছেন শুধু গানের জন্য। জাকিয়া বেগম বলেন,আমার বাবা প্রকৃত বাউল কবি হলেও তিনি অন্যান্য বাউলের মতো সংসারত্যাগী বৈরাগী ছিলেননা। তিনি সংসারী ছিলেন। মাদকমুক্ত বিশুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার এক পবিত্র ধারা প্রতিষ্ঠায় নিরলস শ্রম সাধনা করে গেছেন।

তিনি নামাজ রোজা পালন করতেন। শুক্রবারে গান বাজনা বাদ দিয়ে জুমআর নামাজ আদায়ে তৎপর ছিলেন। রোজার মাসটা ছিল তার আনন্দের মাস। উৎসবের মতো ঘটা করে রোজাব্রত পালনের পাশাপাশি সকল ভক্ত শিষ্যদেরকে নিয়ে একসাথে ইফতার করতেন। আমি তাকে ঘুনাক্ষরেও মদ গাঁজার ধারে কাছে যেতে দেখিনি বা কারো কাছ থেকে এমন অভিযোগ শুনিনি। তিনি গোসল করে পাকপবিত্র অবস্থায় ধ্যানমগ্ন হয়েই মৃত্যুবরন করেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য তিনি পাগলপ্রায় ছিলেন। শতাধিক গান রচনা করেছেন শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ,সাবেক মন্ত্রী অক্ষয় কুমার দাশ ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি নিজেদের লোক মনে করে আমার বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন। আমার বাবার গান শুনে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেবও টাকা দিয়েছেন।

তিনি শুধু ঘরে বসে গান লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি। কলকাতা ভারত,করাচি পাকিস্তান ছাড়াও সারাদেশের এমন কোন জেলা নেই যেখানে তিনি স্বশরীরে হাজির হয়ে কোননা কোন মঞ্চে গান পরিবেশন করেননি। এজন্য থাকে ভ্রাম্যমান বাউল শিল্পী বলা হতো। শাহ আব্দুল করিম ও দূর্বিণ শাহ যেসময় লন্ডনে যান ঠিক সেইসময় তিনিও লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু যারা নেবে তাদেরকে তিনি বলেছিলেন আমি বৃদ্ধ মানুষ আমার নাতি শাকির আহমদ ছাড়া আমি যেতে পারবোনা। কিন্তু আয়োজক স্পন্সররা আমার ছেলে শাকির আহমদ কে এলাউ না করায় তিনি লন্ডনে যাননি। আমার স্বামী আবু জালাল ফকির ও আমার ছেলে শাকির আহমদ আমার বাবার কইলজ্যার টুকরা ছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গা হতে ভক্ত আশেকানরা প্রোগ্রামের আয়োজন করে দাওয়াত দিয়ে তাঁকে বাড়ীতে চিটি পাটাতো।

যারা তাঁকে প্রোগ্রামে নেওয়ার জন্য আসতো তিনি তাদের কাছে কোন বায়না চাইতেননা। আমি নিজে আলাপ করে বায়না চাইতাম। ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাধক রশিদ উদ্দিন,জালাল কবি,কমল শাহ এদের সাথে আমার বাবা পালাগান গেয়েছেন। তিনি খুব বিদ্যাওয়ালা সাধক মানুষ ছিলেন।

সুনামগঞ্জের পথিকৃৎ সাংবাদিক ও আর্টস কাউন্সিল সেক্রেটারী মুহাম্মদ আব্দুল হাই সাহেবের উদ্যোগে সুনামগঞ্জ শহরে ১৯৬৩/৬৪ সালে সর্বপ্রথম যে হাছন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই উৎসবে বাবার সাথে আমিও গিয়েলিাম। উৎসবে দেশের সকল নামকরা শিল্পীকে হারিয়ে আমার বাবা গানের সম্রাট বাউল কামাল পাশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক ও আর্টস কাউন্সিল থেকে।

কামাল পাশার লিখিত গানের পান্ডুলিপির ব্যাপারে তিনি বলেন,আমার বাবার মৃত্যুর পর ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সচিব আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরী লেদু মিয়া ও আমার বাবার নাতি আবুল আজাদসহ কয়েকজন ব্যক্তি বাবার প্রায় শতাধিক গান একটি খাতায় লিখে রাখেন।

লাল কালিতে হাতে লেখা ও দোয়াত কলমের কালি দ্বারা লিখিত বেশ কয়েকটি গানের মূল পান্ডুলিপি,বই প্রকাশের কথা বলে কবি গিয়াস উদ্দিন ও মসরু মিয়াসহ আরো অনেক ভক্ত শিষ্যরা বাবার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। বর্তমানে তারা কেউই বেঁচে না থাকায় আমরা কোন পান্ডুলিপিই উদ্ধার করতে পারিনি।

আমার ছেলেরা জীবিকার জন্য জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত থাকায় যেমন লেখাপড়া করতে পারেনি তেমনি তাদের নানার পান্ডুলিপি উদ্ধারেরও কোন চেষ্টা করেনি। যারা কামালের গান চুরি করেছে তাদেরকে তিনি মনচোর ও ঈমানচোর বলে অভিহিত করেন।

কোন কোন মরমী সাধককে বাউল কামাল পাশার সাথে দেখেছেন জানতে চাইলে জাকিয়া বেগম বলেন,শুধু প্রখ্যাত সাধক উকিল মুন্সীই নন আমাদের বাড়ীতে বিখ্যাত বাউল শাহ আব্দুল করিম সাহেব ও ফকির দূর্বিণ শাহ সাহেবও একাধিকবার এসেছেন। তারা একে অপরের সাথে গানের তত্ত্ব উপাত্ত নিয়ে ভাব বিনিময় করেছেন।

আমি নিজে তাদের মেহমানদারী করেছি। আমার বাবার ধর্ম ছিল যাই থাকতো মেহমানদের সাধ্যমতো আদর আপ্যায়ন করা। গান গেয়ে যা উপার্জন করতেন তাই মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যয় করতেন।

জানা যায়,কামাল কন্যা জাকিয়া বেগম ১৯৩৩ সালে সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ভাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বর্তমানে বার্ধক্যে উপনীত এই বৃদ্ধা জাকির আহমদ,শাকির আহমদ,লাকির আহমদ,দাহির আহমদ ও পাখির আহমদ এবং কছবিয়া বেগম নামে ৫ পুত্র ও ১ কন্যার জননী। তাঁর স্বামী জালাল ফকির জীবদ্ধশায় একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় ও মরমী কবি ছিলেন।

তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শ্রীপুরের ইব্রাহিম শাহ মাস্তানকে মুর্শিদ মান্য করতেন। যিনি বাউল শাহ আব্দুল করিমেরও মুর্শিদ। অন্যদিকে বাউল কামাল পাশার প্রথম স্ত্রী রাবিয়া খাতুন (কার্ফুলের মা) এর একমাত্র উত্তরাধিকারী কন্যা ছিলেন শাফিয়া খাতুন। তিনিও পিতার মৃত্যুর আগে মারা যান।

তবে রেখে যান কন্যা মাফিয়া খাতুন, কোকিলা খাতুন, পুত্র মোঃ শাফি নূর,টুটুল মিয়া,আফিন নূর,আমিন নূর ও জামিন নূর কে। বাউল কামাল পাশার ৫ দৌহিত্র ও ২ দৌহিত্রির মধ্যে বর্তমানে ৪ দৌহিত্র জীবিত আছেন। সিলেটের শাহী ঈদগাহ কলোনীতে ভাড়াটে বাসায় অবস্থান গ্রহন করছেন তারা।

জীবিকার তাগিদে বাউল কামাল পাশার প্রয়াত দুই স্ত্রীর সুযোগ্য ২ কন্যা শাফিয়া খাতুন ও জাকিয়া বেগম প্রায় ৩ যুগ আগে গ্রামের বাড়ী ভাটিপাড়া ছেড়ে সিলেট শহরে চলে আসেন। তাদের মধ্যে কামালের ঔরষজাত কন্যা শাফিয়া খাতুন দারিদ্র্যতার মধ্যে দিনাতিপাতের একপর্যায়ে লোকান্তরিত হলেও শাফিয়া খাতুনের পুত্র কন্যা ও তাদের নাতি নাতনীরা এখন সিলেট শহরেই বসবাস করছেন।

একইভাবে অপর কন্যা জাকিয়া বেগমের সন্তানাদিরাও এখন সিলেট শহরের নাগরিক। ভাটিপাড়া গ্রামে পিয়াইন নদীর তেভাঙ্গার মুখে কালের সাক্ষী হয়ে আছে শুধু বাউল কামাল পাশার একটি কবরস্থান। কবরের পাশেই দৌহিত্রী কছবিয়া বেগমের বসতঘর। যে ঘরটিতে জীবদ্ধশায় বাউল কামাল পাশা তাঁর জীবনের শেষ দিনটি কাটিয়েছেন।

উল্লেখ্য সুনামগঞ্জ জেলার ৫ প্রধান লোককবির মধ্যমনি গানের সম্রাট বাউল কবি কামাল উদ্দিন (কামাল পাশা) ১৯০১ইং সনের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ভাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন এবং ১৯৮৬ ইং সনের ৬ মে মোতাবেক ২০ বৈশাখ শুক্রবার রাতে নিজ বাড়ীতে মৃত্যুবরন করেন।

জীবদ্ধশায় ‘দিলকী দয়া হয়না’ ‘প্রেমের মরা জলে ডুবেনা’ ‘সাজিয়ে গুজিয়ে দে মোরে’ ‘কাঙ্কের কলসী গিয়াছে ভাসি’ ‘চাইনা দুনিয়ার জমিদারী’ ‘দেশে আইলো নতুন পানি ঘুচে গেল পেরেশানী’ ও ‘মুজিব বাইয়া যাওরে ৬ দফারী নাও’ ইত্যাদি নানা তত্ত্বের উপর হাজার হাজার গান রচনা ও পরিবেশন করে বাংলাদেশের মরমী সংস্কৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি।

কথিত আছে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দিরাই থানার রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র জনতার সম্মিলিত প্রতিবাদ সভায়, ‘শেখ মুজিব কারাগারে আন্দোলন কেউ নাহি ছাড়ে/সত্যাগ্রহে এক কাতারে সামনে আছেন সামাদ ভাই।

ঢাকার বুকে গুলি কেন জবাব চাই’ শিরোনামে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বাউল কামাল পাশাই সর্বপ্রথম সংগীত রচনা ও পরিবেশন করেছেন। এছাড়াও সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ৮ বারের রাজনৈতিক সফরসুচি ও নির্বাচনী সমাবেশে আওয়ামীলীগ,স্বাধীনতা, স্বায়ত্বশাসন ও নৌকা প্রতীকের সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর সভামঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন তিনি। এই মহান লোকশিল্পীর ১১০০ গান সংরক্ষণ করে যাচ্ছে “বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ,সুনামগঞ্জ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

স/এষ্