ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৭ নভেম্বর ২০২৫
  1. Bangla
  2. chomoknews
  3. English
  4. অপরাধ
  5. অভিনন্দন
  6. আমাদের তথ্য
  7. কবিতা
  8. কর্পরেট
  9. কাব্য বিলাস
  10. কৃষি সংবাদ
  11. খুলনা
  12. খোলামত
  13. গল্প
  14. গাইড
  15. গ্রামবাংলার খবর
আজকের সর্বশেষ

সাংবাদিকতা সত্যের অন্বেষণ, সমাজের স্মৃতি ও মানুষের মুক্তির ভাষা

চমক নিউজ বার্তা কক্ষ
নভেম্বর ২৭, ২০২৫ ৭:২৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সাংবাদিকতা সত্যের অন্বেষণ, সমাজের স্মৃতি ও মানুষের মুক্তির ভাষা

এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির।। মানুষ তার ভাষার মাধ্যমে পৃথিবীকে বুঝতে শেখে, আর লেখার মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে সময়ের আয়নায় ধরে রাখে। ভাষা হল মুহূর্তের আলাপ; লেখা হল সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘশ্বাস। সময়ের নদী বয়ে চলে, স্মৃতি বিলীন হয়, কিন্তু লেখা তার স্রোতের মধ্যে সত্যের নোঙর গেঁথে দেয়। যে জাতি লেখা সংরক্ষণ করে, সে জাতি তার ইতিহাসকেও সংরক্ষণ করে; যে সমাজ সত্যিকারের সাংবাদিকতা লালন করে, সে সমাজ তার বিবেক রক্ষা করতে পারে।

লেখা কেবল শব্দের বিন্যাস নয়—এটি সময়ের সঞ্চিত জ্ঞান, মানুষের অনুভূতির সংগ্রহশালা এবং সত্যের অধীত পথ। সাহিত্য যেখানে মানুষকে অনুভব করায়, সাংবাদিকতা সেখানে মানুষকে চিনতে শেখায়—নিজেকে, সমাজকে এবং রাষ্ট্রকে।

১. কেন মানুষ লেখে? — সাহিত্যিক উত্তর

মানুষ যখন কথা বলে, শব্দটি বাতাসে মিলিয়ে যায়; কিন্তু মানুষের যন্ত্রণা, প্রত্যাশা, স্মৃতি ও স্বপ্নকে ধরে রাখার ক্ষমতা লেখার মধ্যেই নিহিত। লেখার গভীরে আছে মানুষের অভিজ্ঞতার দীর্ঘ অনর্গল ঝরনা, যা সময়ের কাঁটায় অম্লান থাকে।

আমরা যখন জানালার বাইরে তাকাই, দেখতে পাই—জীবন কত অনিশ্চিত, কত অস্থির। কিন্তু একজন লেখক যখন তার অভিজ্ঞতাকে শব্দে ধরে ফেলেন, তখন সেই অনিশ্চয়তাই হয়ে ওঠে স্থির, সুনির্দিষ্ট, আলোয় প্রকাশিত।

যেমন—বাগেরহাটের কোনো মোরেলগঞ্জে গ্রামে নদী ভাঙে, ঘরবাড়ি ভেসে যায়, শিশুরা আশ্রয়কেন্দ্রের ধুলোয় ঘুমায়, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটায়। এই অভিজ্ঞতার বহু অংশ মুখে বলা যায় না। ভয়, লজ্জা, সামাজিক চাপ, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হুমকি—সব মিলিয়ে মানুষ নীরব হয়ে যায়।

কিন্তু লেখা সেই নীরবতার ভাষা খুঁজে বের করে। মানুষের গোপন কান্নাকে সামাজিক সত্যে রূপ দেয়। এইভাবে লেখা হয়ে ওঠে এক ধরনের মুক্তি—অবলিখিত দুঃখকে লেখা জীবনের আলোতে স্থাপন করে।

সত্যিকারের সাহিত্য জন্ম নেয় সেখানে, যেখানে মানুষের জীবনের গহীন অন্ধকারও শব্দে আলো পায়। আর সাংবাদিকতার লেখা, তাই এক অর্থে, সমাজের কবিতা—মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার ভাষাহীন সুরের প্রকাশ।

২. সাংবাদিকতা — কলমের বিজ্ঞান ও মানবিকতার দর্শন

সাংবাদিকতা কেবল তথ্য সংগ্রহের শিল্প নয়; এটি একটি জিজ্ঞাসা, একটি দর্শন, একটি মানবিক আন্দোলন। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছবিই সমাজের আয়না। সাংবাদিকতা এমন একটি শাস্ত্র যেখানে—

মানবিকতা,

গবেষণা,

নৈতিকতা,

সমাজবিজ্ঞান,

রাষ্ট্রবিজ্ঞান,

ইতিহাস,

ভূগোল
একটি মাত্র কলমের নিবে এসে মিলিত হয়।

সাংবাদিকদের কাজ কেবল সংবাদ লেখা নয়; তারা সমাজের সেই চিত্র তুলে ধরেন, যা আমরা দেখি না, শুনি না, বা বলতে সাহস পাই না।

এ কারণে সাংবাদিকতার বিজ্ঞান হলো—

১. পর্যবেক্ষণ
২. অনুসন্ধান
৩. সাক্ষাৎকার
৪. তথ্যযাচাই
৫. বিশ্লেষণ
৬. ঘটনার সময়-প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা
৭. সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতির সঙ্গে ঘটনার সম্পর্ক নির্ণয়

এগুলি ছাড়া সংবাদ পরিণত হয় গুজবে, সাংবাদিকতা পরিণত হয় বিশৃঙ্খলায়। তাই সাংবাদিকতা একাধারে শিল্প, বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও যুক্তির সমন্বিত জ্ঞান।

৩. দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল—গবেষণার এক অনন্ত ক্ষেত্র

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, বিশেষত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ অঞ্চল—এগুলো শুধুই ভূগোল নয়, এগুলো জীবনের সংগ্রাম, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস এবং মানুষের অদম্য টিকে থাকার ডায়েরি।

৩.১ উপকূলের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা

এই অঞ্চলে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা এখানে গবেষণা করেন—

লবণাক্ততার বিস্তৃতি,

ঘূর্ণিঝড়ের পুনরাবৃত্তি,

নদীর পলল ব্যবস্থা,

পোল্ডার সিস্টেমের দুর্বলতা,

জলবদ্ধতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব,

ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি,

কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন
ইত্যাদি।

কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা বলতে পারে না। তাদের ভাষা সহজ—
“পানি আসে, ঘর ভাঙে, জীবন থেমে যায়।”

সাংবাদিক সেই সরল কষ্টকে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের আলোকিত শব্দে তুলে ধরেন। তিনি মানুষের অভিজ্ঞতা আর বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার সেতুবন্ধন তৈরি করেন।

৩.২ সমাজবৈজ্ঞানিক বাস্তবতা

ঘর হারানো মানুষ যখন অন্য জায়গায় যায়, তখন শুধু কাঠ-বাঁশের ঘর নয়, হারিয়ে যায়—

সামাজিক পরিচয়

আত্মীয়তা ও পাড়ার সম্পর্ক

সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা

বিদ্যালয়ের শিক্ষা

নারীর নিরাপত্তা

শিশুর ভবিষ্যৎ

জীবিকার পথ

সমাজবিজ্ঞানীরা এসব লিখেন গবেষণায়। কিন্তু সাংবাদিক লেখেন মানুষের কণ্ঠ থেকে শেখা ভাষায়। তাই দুই ধরনের লেখা মিলেই সম্পূর্ণ সমাজকে তুলে ধরে।

৪. সাংবাদিকতা—সমাজের নীরব প্রশ্নগুলোর উত্তর

একটি ভালো সংবাদ শুধু তথ্য দেয় না, বরং এটি এমন প্রশ্ন তৈরি করে যা পরিবর্তনের সূচনা করে—

কেন বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা?

নদী খননের প্রকল্পের টাকা যায় কোথায়?

কেন সুন্দরবনের পাশের জীবন এত অনিরাপদ?

লবণাক্ততার কারণে কৃষি বদলে ঘের অর্থনীতি কেন বেড়েছে?

নারী ও শিশুর জীবন কেন বেশি ঝুঁকিতে?

উন্নয়ন প্রকল্প কারা পায়, কারা পায় না?

সাংবাদিকতার শক্তি এখানেই—এটি প্রশ্ন করতে শেখায়।
প্রশ্নই মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তোলে।
চেতনা রাষ্ট্রকে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করায়।

পরিবর্তনের সূচনা সবসময় একটি প্রশ্ন থেকেই হয়—
এ প্রশ্ন সৃষ্টি করেন সাংবাদিক।

৫. সময়ের আর্কাইভ—সাংবাদিকতার লেখা

ইতিহাস কেবল যুদ্ধ-বিপ্লব আর রাজনীতির গল্প নয়; ইতিহাস হল মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার লেখা। সেই অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ করেন সাংবাদিকরা।

’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়, ২০০৯ সালের আইলা, ২০০৭ সালের সিডর, ২০২০ সালের আম্পান—
এসব দুর্যোগের স্মৃতি আমরা জানি কারণ কেউ তখন লিখেছিল, ছবি তুলেছিল, তথ্য রেখেছিল।

সাংবাদিকতা তাই—

ভবিষ্যতের কাছে অতীত পৌঁছে দেওয়ার সেতু

সময়ের চোখ

মানুষের অভিজ্ঞতার খাতাপত্র

রাষ্ট্রের জবাবদিহির দলিল

যে সমাজ নথিবদ্ধ করে, সে সমাজ ভুলে যায় না।

৬. সাংবাদিকতা—সাহিত্যের রূপ, বিজ্ঞানের গভীরতা

সাহিত্য মানুষকে অনুভব করায়; বিজ্ঞান মানুষকে বুঝতে শেখায়।
সাংবাদিকতা মানুষকে উভয় দিকেই পরিচালিত করে।

একটি মাঠ-রিপোর্ট যখন লবণাক্ততা নিয়ে আসে, তখন তা শুধু তথ্য নয়—

এটি যন্ত্রণার সাহিত্য

গবেষণার উপাত্ত

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ

অর্থনীতির প্রবণতা

পরিবেশবিজ্ঞানের সতর্কতা

সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা মানুষের জীবন ও রাষ্ট্রের গতিপথকে একই ফ্রেমে ধরে।

এ কারণেই সাংবাদিকতা একইসঙ্গে একটি জ্ঞান, একটি নৈতিকতা ও একটি মানবিক শিল্প।

৭. সংবাদপত্র—দেশের চলমান সময়ের আয়না

সংবাদপত্র শুধু খবর দেয় না—
সংবাদপত্র ব্যাখ্যা দেয়, পথ দেখায়, ভুল ধরিয়ে দেয়, সত্য উন্মোচন করে।

ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়—

ভাষা আন্দোলনে সাংবাদিকতার ভূমিকা

’৭১-এ গণহত্যার ঘটনাপ্রবাহ নথিবদ্ধ করা

’৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিবেদন

সামরিক শাসনের সময়ে প্রান্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের দলিল

সংবাদপত্র না থাকলে—

গণতন্ত্র দুর্বল হয়

মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়

রাষ্ট্রের ভুল চাপা পড়ে

দুর্নীতি অচিহ্নিত থাকে

ইতিহাস বিকৃত হয়

সংবাদপত্র তাই শুধু তথ্যের উৎস নয়—
এটি জাতির বিবেক ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার মাপকাঠি।

৮. সাংবাদিকের চরিত্র—গবেষণা ও নৈতিকতার অপরিহার্য সমন্বয়

একজন সত্যিকারের সাংবাদিককে একইসঙ্গে—

গবেষকের মতো হতে হয়

তথ্য খুঁজতে

উৎস যাচাই করতে

তুলনা করতে

তথ্য-তত্ত্ব-বিশ্লেষণের ভিত্তি খুঁজতে

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করতে

এবং সাহিত্যিকের মতো হতে হয়

শব্দের সৌন্দর্য বজায় রাখতে

মানুষের মর্যাদা রক্ষা করতে

কষ্টকে সম্মানের সঙ্গে উপস্থাপন করতে

পাঠকের চেতনা জাগিয়ে তুলতে

কিন্তু সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় গুণ—
সততা।
সততা ছাড়া সাংবাদিক কেবল সংবাদকর্মী; সমাজের প্রতিনিধি নয়।

৯. সাংবাদিকতা—স্বার্থের জন্য নয়, মানুষের জন্য

আজকের পৃথিবীতে সাংবাদিকতার পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে—

চাঁদাবাজি

দলবাজি

হলুদ সাংবাদিকতা

ভুয়া তথ্য

ক্লিকবেইট

ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার কলম

এসব সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়, মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়।

কিন্তু সত্যিকারের সাংবাদিক—

মানুষের জন্য লেখেন

অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ান

দুর্বল মানুষের কণ্ঠকে তুলে ধরেন

রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা রক্ষায় কাজ করেন

নীরবতার দেয়াল ভেঙে দেন

সাংবাদিকতা স্বার্থের জন্য নয়—মানুষের জন্য।

১০. উপসংহার — লেখা: সত্য রক্ষার সর্বশক্তিশালী অনুশীলন

শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতার মূল কথা—
সত্য, মানুষ, দায়িত্ব।

কলমের শক্তি বন্দুকের চেয়ে বড়;
বন্দুক ভয় দেখায়,
কলম ভয় ভাঙায়।

আমরা কেন লিখি?

সত্য বাঁচাতে

অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে

নীরব মানুষের কণ্ঠস্বর হতে

ইতিহাস সংরক্ষণ করতে

ভবিষ্যতের পথ দেখাতে

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে

সবচেয়ে বড় কথা—
আমরা লিখি মানুষ হতে, মানুষকে মানুষ রাখতে।

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মতো সংকটময় অঞ্চলে একজন সাংবাদিকের প্রতিটি লেখা হয়ে ওঠে—
মানুষের টিকে থাকার ডায়েরি,
রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরা প্রশ্নপত্র,
ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া দায়বদ্ধ ইতিহাস।

এ ইতিহাস লেখা না হলে—
সমাজ অন্ধ হয়ে যায়,
রাষ্ট্র বধির হয়ে যায়।

সাংবাদিকের কলম তাই কেবল কালির দাগ নয়—
এটি সত্যের আগুন, মানুষের মুক্তির আলো।