রাহুল রাজ ।। বিশাদ হোসেনের ঘূর্ণি বলে কুপোকাত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস দেখে যে ম্যাচকে ম্যাড় মেরে একপেশে ম্যাচ বলে মনে হচ্ছিল। দিনশেষে সেই ম্যাচকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিল বাংলাদেশ। রিশাদের বাঁকে নির্বাক হয়ে একের পর এক ক্যারিবিও ব্যাটসম্যানরা সাজঘরে আসা যাওয়ার মিছিলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ২০৮ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে মাত্র ১৩৩ রানে অলআউট হয়ে যায় অতিথিরা।
ফলে ৭৪ রানের বড় ব্যাবধানে জিতে যায় বাংলাদেশ। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলতে নামলে প্রথম পাওয়ার প্লে দেখে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন হেসে খেলেই ম্যাচ জিততে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু সেই চিন্তা ও ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে কাল পিচে নিজেদের জয় তুলে নিতে কোন রকম বেগ পেতে হয়নি টিম বাংলাদেশকে। রোদের তাপের কারণেই হোক আর বাংলাদেশের সম্প্রতি সময়ের বাজে ফর্মের কারণেই হোক প্রথম ইনিংসে মাঠে খুব বেশি দর্শকের আগমন চোখে পড়েনি।
তবে দিনের আলো পড়তেই ফ্লাডলাইট জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে চোখে পড়ার মতন দর্শক সমাগম ঘটে। চোখ ধাঁধানো বোলিংয়ে বাংলাদেশের জয় দর্শকদের সেই কষ্ট লাঘব হয়েছে ষোল আনা। ১৪ ম্যাচ পর বাংলাদেশ একদিনের ম্যাচ জিতলেও মিরপুরের সেই পিচ থেকে যাচ্ছে প্রশ্নবোধক চিহ্নের নিচে।
সর্বশেষ দ্বিপাক্ষিক সিরিজে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সিরিজের পর খুব একটা অনুশীলনেরও সুযোগ পায়নি টাইগাররা। দিন তিনেক পরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামতে হয়েছে। এবার ঘরের মাঠে ফিরে অবশ্য হারের বৃত্ত ভেঙেছে মেহেদি হাসান মিরাজের দল। মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭৪ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে সিরিজে ১-০তে এগিয়ে গেল স্বাগতিকরা। মিরপুরে টস হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে ৪৯ ওভার ৪ বলে সবকটি উইকেট হারিয়ে ২০৭ রান করে বাংলাদেশ।
দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৫১ রান করেছেন তাওহিদ হৃদয়। এ ছাড়া ৪৬ রান করেছেন মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন। জবাবে খেলতে নেমে ৩৯ ওভারে ১৩৩ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ছোট লক্ষ্য তাড়ায় উড়ন্ত শুরু পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উদ্বোধনী জুটিতে ৫১ রান যোগ করে তারা। ২৭ রান করা আলিক আথানজেকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে ক্যারিবিয়ান শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন রিশাদ হোসেন।
উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পরই ক্যারিবিয়ানদের রানের লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ। তিনে নামা কেসি কার্টি দেখে-শোনে খেলছিলেন, তবে উইকেটে থিতু হয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি তিনি। ২০তম ওভারে রিশাদের বলে স্লিপে সাইফ হাসানের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি।
সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩০ বলে ৯ রান। নিজের পরের ওভারে ফিরে আরো দুই উইকেট নিয়েছেন রিশাদ। ওভারের প্রথম বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ব্যান্ডন কিংয়ের ব্যাট ছুঁয়ে যায়। উইকেটকিপার সোহান দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় বল গ্লাভসবন্দি করেন। কিং ৬০ বলে করেছেন ৪৪ রান। চতুর্থ বলে ফিরিয়েছেন শারেফান রাদারফোর্ডকে।
সোহানের গ্লাভসবন্দি হয়ে ডাক খেয়েছেন তিনি। ২৪তম ওভারে আবারো উইকেটের দেখা পান রিশাদ। এবার তার শিকার রোস্টন চেজ। ৬ রান করে চেজ ফিরলে ৯২ রানেই পঞ্চম উইকেট হারায় ক্যারিবিয়ানরা। আর এই ৫ উইকেটের সবকটি গেছে রিশাদের ঝুলিতে। এটি তার ক্যারিয়ারের প্রথম ফাইফার। বাংলাদেশের প্রথম ডানহাতি স্পিনার হিসেবেও ওয়ানডেতে ৫ উইকেট পেয়েছেন রিশাদ। একশর আগেই ৫ উইকেট হারানো উইন্ডিজ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রোস্টন চেজ-গুড়াকেশ মোতিরা চেষ্টা করেও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। উইন্ডিজের ইনিংসে শেষ পেরেক মারেন রিশাদ। ৩৯তম ওভারে বোলিংয়ে ফেরেন এই লেগি।
তার শেষ বলে মেহেদি হাসান মিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন জেডন সিলস। এই উইকেটসহ ম্যাচে ৬ উইকেট পেয়েছেন তিনি। যা তার ক্যারিয়ার সেরা। একই সঙ্গে কোনো বাংলাদেশি স্পিনারেরও ওয়ানডেতে সেরা বোলিং ফিগার এটি। এর আগে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের প্রথম ওভারেই বাউন্ডারিসহ ৭ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। তবে সেই শুরু বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। দ্বিতীয় ওভারেই লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন সাইফ হাসান। ইনফর্ম এই ওপেনার ৬ বল খেলে ৩ রানের বেশি করতে পারেননি। পরের ওভারেই ফিরেছেন সৌম্য সরকারও।
তৃতীয় ওভারের প্রথম বলটি অফ স্টাম্পের বাইরে করেছিলেন জেইডেন সিলস। সেখানে জায়গায় দাঁড়িয়ে কভার পয়েন্টের উপর দিয়ে খেলতে চেয়েছিলেন সৌম্য। টাইমিং না হওয়ায় ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে রোস্টন চেজের হাতে ধরা পড়েন। এই ওপেনারের ব্যাট থেকে এক চারে ৬ বলে ৪ রান এসেছে। ৮ রানে ২ উইকেট হারানো বাংলাদেশের হাল ধরেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও তাওহিদ হৃদয়। তৃতীয় উইকেট জুটিতে তারা যোগ করেন ৭১ রান।
৩২ রান করে শান্ত ফিরলে ভাঙে সেই জুটি। শান্ত থিতু হয়ে ফিরলেও ব্যক্তিগত ফিফটি পেয়েছেন হৃদয়। এই মাইলফলক ছুঁতে ৮৭ বল খেলেছেন তিনি। কিছুটা ধীরগতির ব্যাটিং করলেও উইকেট বিবেচনায় হৃদয়ের এই ইনিংস কার্যকরী ছিল। ফিফটির পর আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। সবমিলিয়ে ৯০ বলে করেছেন ৫১ রান। হৃদয়ের পর দায়িত্ব নিয়ে এক প্রান্ত আগলে রেখে ব্যাটিং করেছেন অঙ্কন।
অভিষিক্ত এই উইকেটকিপার ব্যাটার ফিফটির কাছাকাছি গিয়ে আউট হয়েছেন। ইনিংসের ৪৬তম ওভারে রোস্টন চেইজকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়েছেন। তার আগে ৭৬ বলে করেছেন ৪৬ রান। অঙ্কন ফেরার পর দুইশ স্পর্শ করা নিয়েও শঙ্কা জেগেছিল। তবে শেষদিকে রীতিমতো ঝড় তোলেন রিশাদ হোসেন। এক চার আর দুই ছক্কায় ১৩ বলে ২৬ রান করেছেন তিনি। তাতে দুইশ ছুঁয়েছে বাংলাদেশ।
ম্যাচ সেরা ১৩ বলে ২৬ ও ৩৫ রানে ৬ উইকেট তুলে নেওয়া রিশাদ হোসেন। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের তৃতীয়সেরা বোলিং এটি। ২৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে রেকর্ডটি ভাগাভাগি করছেন দুই পেসার মাশরাফি বিন মুর্তজা ও রুবেল হোসেন। এ ছাড়া ৬ উইকেট আছে মোস্তাফিজুর রহমানের (৬/৪৩)।’