সওকত হোসেন আন্জুঃ খেলার মাঠের সাদা মানুষ
লেখকঃ মোঃ সামসুল ইসলাম, ক্রীড়া ভাষ্যকার, বেতার ও টেলিভিশন : ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অমোঘ আকর্ষণ অনেককেই দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে তাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে। মোঃ সওকত হোসেন আন্জু তেমনি একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান। রাজশাহী তথা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক মুকুটহীন সম্রাট সওকত হোসেন আন্জু। তিনি ছিলেন একাধারে ক্রীড়াবিদ, কোচ, রেফারী/আম্পায়ার, ক্রীড়া সংগঠক,শরীর চর্চা শিক্ষক এবং গীতিকার। ক্রীড়াঙ্গনের বহুমাত্রিক গুণে গুনান্বিত এই মানুষটি বিগত ছয় দশক ধরে ক্রীড়া এবং সংস্কৃতিক কর্মকান্ডেনিজেকে নিয়জিত রেখেছেন নিরলসভাবে। তাঁর এই পথচলা আরোও সাফল্যমন্ডিত হোক এবং ফুলে ফলে সুশোভিত হোক তাঁর অবসর জীবন, এই প্রত্যাশায় তুলে ধরছি তাঁর জীবনের গল্পগাঁথা।
মৃত মোকবুল হোসেন এবং মৃত রিজিয়া বেগম দম্পতির জৈষ্ঠ সন্তান মোঃ সওকত হোসনে আন্জু রাজশাহীর কাজিহাটায় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই- তিন বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। শৈশবে এক সম্মৃদ্ধ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেন।তিনি এবং তাঁর পরিবারের অনেকেই (ভাই, ছেলে) রাজশাহীর ক্রীড়াঙ্গনে হকি, ফুটবল, ক্রিকেট এবং বাস্কেটবল লীগে সুনামের সাথে খেলেছেন।
ক্রীড়াবিদঃ
স্কুল জীবনেই তিনি ক্রীড়াবিদ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। ক্রীড়াঙ্গনে সুপরিচিত রাজশাহীর বিখ্যাত মুসলিম হাই স্কুল দলের হয়ে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ অব্দি তিনি আন্তঃ স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল এবং এ্যাথলেটিকসে কৃতিত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেন এবং ক্রমান্বয়ে থানা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে নিজ স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করেন।উল্লেখ্য মুসলিম হাই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন জনপ্রিয় রহমত হোসেন স্যার। তাঁর হাত ধরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে খোদা বকশ মৃধা, সওকত হোসেন আন্জু, প্রমুখ নামকরা ক্রীড়াবিদ উঠে এসেছেন এবং দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলো ছড়িয়েছিলেন সেসময়। তবে ফুটবল ও ক্রিকেটে তাঁর প্রথম ওস্তাদ ছিলেন মরহুম ক্রীড়া সংগঠক জাফর ইমাম। বাস্কেটবলে সুলতান সাহেব এবং হকিতে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইশহাক তাঁর প্রথম কোচ।স্কুল জীবন থেকেই তিনি রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃক আয়োজিতফুটবল, হকি, ক্রিকেট এবং বাস্কেটবল লীগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে সাফল্যের সাথে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৪ টানা ২২ বছরব্যাপী তিনি বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে প্রথম বিভাগ লীগে খেলেন।
পাশাপাশি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল অব্দি তিনি আন্তঃ কলেজ, আন্তঃ শিক্ষা বোর্ড ও আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফুটবল, হকি এবং বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৪ সাল অব্দি তিনি সাফল্যের সাথে রাজশাহী জেলা দলের হয়ে হকি ও ফুটবলে বাংলাদেশ গেমস এবং অন্যান্য জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণঃ
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পুলিশ বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৭ এপ্রিল ১৯৭১ তিনি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় বেলডাঙ্গা থানায় শরনার্থি হিসেবে অবস্থান শুরু করেন। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর জেলার ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবের নিবন্ধিত ফুটবলার হিসেবে প্রথম বিভাগ লীগে খেলার সুযোগ পান। দেশ স্বাধীন হলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ
খেলাধূলায় নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি তাঁর। তিনি রাজশাহী মুসলিম হাই স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি এবং ১৯৭১ সালে রাজশাহী নিউ গভঃ ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি শারিরীক শিক্ষা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে জেডইপিই কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ব্যাসিক স্কাউট কোর্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তিতে ১৯৮৫ সালে শহীদ মামুন মাহমুদ পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজ রাজশাহীতে তিনি শরীর চর্চা শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
সেখানে তিনি তাঁর স্কুল ছাত্রদের ক্রীড়া মনস্ক সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় খুব দ্রুত স্কুলে ফুটবল, হকি এবং হ্যান্ডবলের শক্তিশালী দল গড়ে তুলেন তিনি এবং থানা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেতে থাকেন। তাঁর প্রশিক্ষণে স্কুল দলটি ৯বার আন্তঃ স্কুল হকিতে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায়। এদের অনেকেই পরবর্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে হকি খেলেছেন। ২০১৩ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশা থেকে সুনামের সাথে অবসর গ্রহণ করেন।
ক্রীড়া সংগঠকঃ
যুবক বয়স থেকেই তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় এবং তিনি একইসাথে ক্রীড়াবিদ এবং সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তাঁর সাংগঠনিক কর্মকান্ডেমুগ্ধ হয়ে রাজশাহীর ক্রীড়াঙ্গনের উজ্ঝ্বল নক্ষত্র জাফর ইমামের নিজ হাতে গড়া ফ্রেন্ডস স্পোর্টিং ক্লাব এবং হিরোজ স্পোর্টিং ক্লাবেরসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ১৯৭২ সালে। নিজে একজন রানিং খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দুটি ক্লাবকে রাজশাহীর ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল এবং হ্যান্ডবল লীগে নিয়মিত অংশগ্রহণ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আমি নিজে ফ্রেন্ডস স্পোর্টিং ক্লাবের একজন প্রাক্তন ক্রিকেটার হিসেবে দেখেছি,রাজশাহীতে সীমিত বাজেটে এবং কোন প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষক ছাড়াই, দিনের পর দিনক্লাব দুটি বিভিন্ন ইভেন্টে নিয়মিত অংশ নিয়ে সাফল্য বয়ে এনেছে।
এক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবদানও কিছু কম নয়। তাঁর সহধর্মীনি, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে সবাই বাবাকে সাংগঠনিক কাজে নিবিড়ভাবে সাহায্য করেছেন। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার একাধিক কমিটিতে সদস্য হিসেবে কাজ করেন। রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচিত নির্বাহী সদস্য হিসেবে সুদীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পরে ১৯৮৫ থেকে ২০০৩ অব্দি তিনি রাজশাহী জেলা হকি সমিতির সম্পাদক হিসেবে টানা ১৯ বছর সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০৩ সাল অব্দি তিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা,সততা এবং নিষ্ঠা রাজশাহী তথা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত।
রেফারী/আম্পায়ারঃ
খেলোয়াড় থাকাকালীন ১৯৭৭ সালে তিনি রাজশাহী লীগের ফুটবল রেফারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন এবং ১৯৯০ সালে জাতীয় রেফারী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। রেফারিং ক্যারিয়ারে জেলা, বিভাগ, জাতীয় (ঢাকা লীগ) এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসাথে তিনি ১৯৭৭ সাল থেকেই হকি, বাস্কেটবল ও হ্যান্ডবলে আম্পায়ার হিসেবে জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রশিক্ষকঃ
১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫ সাল অব্দি রাজশাহী বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের পুরুষ ও মহিলা হকি দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেনএবং অনেক সাফল্য বয়ে এনেছেন। তাঁর নিপুণ প্রশিক্ষণে শহীদ মামুন মাহমুদ পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজ হকি দল ৯বার আন্তঃ স্কুল হকিতে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায়। এসব খেলোয়াড়ের অনেকেই পরবর্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া আনেক বাস্কেটবল ও হ্যান্ডবল খেলোয়াড়ও তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে, যারা পরে জাতীয় পর্যায়েও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর ফ্রেন্ডস স্পোর্টিং ক্লাব থেকে অনেক ক্রিকেটার জেলা দল, বিভাগীয় দল, ঢাকা লীগের বিভিন্ন ক্লাব এবং জাতীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ করে নিয়েছে।
গীতিকারঃ
মাঠের মানুষ যে সংস্কৃতিমনাও হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন সওকত হোসেন আন্জু। তিনি সারাদিন মাঠে থাকার পরেও যে দুদন্ড অবসর পান তখন তিনি মনের আনন্দে লেখেন গান ও কবিতা। তাঁর এই নেশা আর দক্ষতার স্বীকৃতি হলো- ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ বেতারের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে গান লিখছেন এবং সেসব গান বেতারে প্রচার হচ্ছে। তাঁর লেখা কবিতা ও গানগুলোর সমাহারে সম্প্রতি তিনি একটি ইউটিউব চ্যানেল (https://www.youtube.com/c/FriendsSong) চালু করেছেন। তাঁর গানে ও কবিতায় মা, মাটি, দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি, প্রেম, মানবতাবোধ ও সমসাময়িক বিষয় সবই উঠে এসেছে অকৃপনভাবে।
সম্মাননাঃ
এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নিরলসভাবে বিগত ছয় দশক ধরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সব্যসাচি ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব সওকত হোসেন আন্জু। তাঁর এই থ্যাংকলেস জবের জন্য ইতিমধ্যে তিনি রাজশাহী ক্রীড়া লেখক সমিতি কর্তৃক সেরা রেফারীর সম্মাননা, জেলা ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃক সংগঠক হিসেবে সম্মাননা এবং শহীদ মামুন মাহমুদ পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০১১ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত হন।
শেষের কথাঃ
আমরা বলতে চাই, তাঁর মতো সব্যসাচি ক্রীড়াবিদ ও বহুমাত্রিক গুণের অধিকারি ক্রীড়া ব্যাক্তিত্বের জাতীয় পর্যায়ে সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়া উচিৎ। সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয় বিষয়টি বিবেচনায় নিবেন। তিনি বলেন- তাঁর মতো শিক্ষকের জীবনে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো- তার ছাত্র/ছাত্রীবৃন্দ, যারা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ সেবা করছেন। ক্রীড়াঙ্গনের জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করা এই সাদা মনের মানুষটি, রাজশাহী তথা এদেশের ক্রীড়া উন্নয়নে তার বহুমাত্রিক অবদানের জন্য আজন্ম বেঁচে থাকবেন কোটি হৃদয়ে।
স/এষ্