দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসে ঘুষ ছাড়া নড়ে না কোন ফাইল, মানুষ জিম্মি দালাল চক্রে
মো: রফিকুল ইসলাম মিঠু।। উত্তরা বিআরটিএ অফিস চত্বরে পা দিতেই ঘিরে ধরে দালালচক্র। সবার মুখে একই কথা-‘কী কাজ ভাই। কেন এসেছেন? কী করতে হবে?’ এরপর অনেকটা প্রকাশ্যেই দরকষাকষি শুরু হয়।
উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসের মূল ভবন থেকে শুরু করে আশেপাশের চায়ের স্টল, ফটোকপির দোকান, এমনকি ফাঁকা মাঠ-সর্বত্র দালালদের ছড়াছড়ি। ফলে সেবা গ্রহিতার ভোগান্তি চরমে পৌঁচ্ছায়।। প্রতিদিন অফিস চত্বরে অবস্থান করে দালালচক্র।
বিআরটিএ কার্যালয়ে পরতে পরতে ঘুষের দর বাঁধা। এর মধ্যে ছয় থেকে আট ধরনের কাজে ঘুষ বাণিজ্য ব্যাপক। বিশেষ করে নম্বর প্লেট, ফিটনেস, লার্নার, মালিকানা পরিবর্তন, রেজিস্ট্রেশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত কাজে ঘুষ বাণিজ্য প্রকাশ্যেই চলছে।
দালালচক্রের মাধ্যমে প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দরে ঘুষ আদায় করা হয়। যেমন : যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কাজে ২ থেকে ৪ হাজার, মালিকানা পরিবর্তনে ৩ হাজার, ফিটনেস সংক্রান্ত কাজে এক থেকে দেড় হাজার টাকা ঘুষ কাউকে না কাউকে দিতেই হচ্ছে।
এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় পাশ করতে হলে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ দেওয়া ‘বাধ্যতামূলক’ আইনে পরিনত হয়েছে দিয়াবাড়ি বিআরটিএ আফিসে।
দেখা যায়, অফিস চত্বরে দিনভর এক থেকে দুই হাজার সেবা প্রার্থী আসেন। এর মধ্যে পাঁচশত এর বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত। কেউ ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে, কেউ আবার পেন্ডিং লাইসেন্স পেতে চরকির মতো ঘুরছেন। অবশ্য দালাল ধরলে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না।
ড্রাইভিং পরীক্ষার মাঠে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সাদা চুনের দাগ টেনে পাশাপাশি মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের ড্রাইভিং পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে লোকজনের ভিড়সহ সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ কম।
পরীক্ষার সময়সীমা সর্বোচ্চ ৫ মিনিট। এতে পাশের হার খুব কম। তবে ফেল করলে অসুবিধা নেই। সিস্টেমে পাশ দেখানোর ব্যবস্থা আছে দালালচক্রের হাতে। এ কারণে পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রার্থীদের বেশির ভাগই দালাল ধরে আসছেন। যাদের বাইরে থেকে দেখলে দালাল হিসাবে আঁচ করার উপায়ও নেই। তারা অতিশয় ভদ্রলোক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একব্যক্তি বলেন, এখানে দালালদের কাছে মানুষ জিম্মি। প্রত্যেক স্যারের নিজস্ব গেটিস (দালাল) আছে। ভাসমান দালালরা পার্টি ধরে। তারা ‘কেস’ অনুযায়ী দরকষাকষি করেন। অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর ফাইল যায় গেটিসের কাছে।
পরে হাতে হাতে ফাইল পৌঁছে যায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার টেবিলে।
অভিযোগ আছে উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিস সহায়ক জীবন (জীবন ভাই) গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি দালল চক্র। উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসের সরকারি চাকরি করলেও তার মূল কাজ দালালি করা। জীবনই মূলত এই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এখানকার বিভিন্ন কর্মকর্তাদের হয়ে তিনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঘুষ বাণিজ্য করে থাকনে। প্রতিদিন অফিস ছুটির আগে ফাইল গুনে ঘুষের টাকা হিসাব দেন কর্মকর্তাদের।
অফিসের বাইরেও জীবনের সঙ্গে এখানকার বিভিন্ন দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের ফাইল প্রতি বা মাসিক চুক্তি হিসাব রয়েছে।
জীবন বিভিন্ন সাংবাদিক ও প্রশাসন ম্যানেজ করে উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসের অলিখিত কর্মকর্তা বনে গেছেন।
গাম্ভিজের সুরে জীবন অনেককেই বলে থাকেন উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসের তার কথাই শেষ কথা। এখানে কোন কাজ হতে হলে তার সাহায্য ছাড়া সেই কাজ কোন ভাবেই সম্ভব না।
প্রতিদিন এভাবে চলে অবৈধ টাকার ভাগবাঁটোয়ারা। ফিটনেস অফিসার,মোটর যান পরিদর্শক আবুবকর সহ নানা দপ্তরে বন্টন হয় ক্ষমতা মাফিক।
আইন এখনে অসহয়। জীবন নামের মধ্যস্থভোগীর খুঁটির জোর ও সিন্ডিকেট এখনি রুখতে না পারা গেলে উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসের সেবার মান অচিরেই কালো কালির নিচে চাপা পড়বে বলেই ভূক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
দেখা যায়, বিআরটিএ কর্মকর্তাদের নিজস্ব গেটিস হিসাবে পরিচিত দালালরা বেশ ক্ষমতাধর। তারা নিমিষেই যে কোনো সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম। তবে সাধারণ সেবাপ্রার্থীদের পক্ষে আসল দালালের দেখা পাওয়া দুষ্কর। ভাসমান দালালদের মাধ্যমে তাদের কাছে যেতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দালালদের কয়েকজন বলেন, উত্তরা বিআরটিএ অফিসে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ‘ডাইরেক্ট কানেকশন’। এছাড়া দালাল সোহেল, আবু বক্কর, রুবেল, বাবু ও শামসু সক্রিয়। এর বাইরে মাঠপর্যায়ে ভাসমান দালাল আছে অসংখ্য।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিয়াবাড়ি বিআরটিএ উপ পরিচালক কাজী মোঃ মোরছালীন ( ইঞ্জিনিয়ার) এছাড়া কয়েকজন পরিদর্শক এবং অফিস সহায়ক নিয়ে অফিসের জনবল ২০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঘুসের অভিযোগ রয়েছে।
কাজী মোঃ মোরছালীন বলেন, ‘বাইরে থেকে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা ঠিক নয়। দালালচক্র নিজেদের সুবিধার জন্য কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে চলে। সাধারণ মানুষের উচিত তার সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। তা না করে অনেকেই দালালচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফলে তিনি অহেতুক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন। এর জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘাড়ে দায় চাপানো অন্যায়।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সীমানাপ্রাচীরবিহীন অফিস চত্বর পুরোটাই অরক্ষিত। একটি তিনতলা ভবন ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চলছে। প্রায় প্রতিটি কক্ষে ফাইল এবং এলোমেলো কাগজের স্তূপ। সহকারী পরিচালকের কক্ষে সিসি ক্যামেরায় বাইরের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা আছে। ফলে টিভি পর্দায় স্পষ্ট ভেসে উঠছে দালালদের চেহারা।
কিন্তু দালালদের প্রতিরোধ করার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। বরং অফিসের সর্বত্র বেসরকারি কোম্পানি, গাড়ির শোরুম এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি একেবারে চরমে। যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে কারা বহিরাগত। কর্মকর্তাদের কক্ষে বসেই তাদের অনেকেই নিজেদের দাপ্তরিক কাজকর্ম অনায়াসে সেরে নিচ্ছেন। কেউ কেউ খোশগল্পে মত্ত।
অফিস চত্বরে পুলিশের নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখা যায়। তারাও কাঠের পুতুলের মতন। কিছু দিয়ে ধাক্কা দিলেই নড়েচড়ে ওঠেন।
অফিস সংলগ্ন মুনসুর আলী মার্কেটের প্রায় প্রতিটি দোকান দালালদের আনাগোনায় মুখরিত।
ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে উত্তরা দিয়াবাড়ি বিআরটিএ অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তার ঘুষ বাণিজ্যের তালিকা ও নাম।
স/এষ্