৭ই মার্চের ভাষণ এক অমর কাব্য
মোঃ ইলিয়াছ মোল্লা- মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৷ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ ৷ ৫১ বছরেও ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি ৷ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে ৷ গবেষণা হয়েছে ৷ পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছে ৷
২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ৷ গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা ৷ যে-কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী ৷ এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে ৷ ফলে এই ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়েছে ৷ আর একজন মানুষ একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন, যেখানে স্বল্প সময়ে কোনো পুনরুক্তি ছাড়াই একটি জাতির স্বপ্ন , সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন ৷
তিনি বিশ্বাসের জায়গা থেকে কথা বলেছেন ৷ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষায় কথা বলেছেন ৷ সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে পেরেছেন ৷ তাঁরা যা চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তা-ই তাঁদের কাছে তুলে ধরেছেন ৷ ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয় ৷ এই ভাষণই একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে ৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই ভাষণ প্রেরণা জুগিয়েছে ৷ আর এতবছর পরও মানুষ তাঁর ভাষণ তন্ময় হয়ে শোনেন ৷
১৯৭১ সালের এই দিনে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শোনান ৷ এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংরাম” তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআলাহ!” কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে ৷ আর বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন কবি হিসেবে ৷ তিনি তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার শেষাংশে লিখেছেন, ‘‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা/কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;/‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’৷” কবি নির্মলেন্দু গুণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ৷
এরমধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং ৷ কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ বলতে পারে ৷ অন্য কোনো ভাষণ এভাবে স্কুল- কলেজের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে মুখস্থ বলতে পারে বলে আমার জানা নাই ৷ কাব্যগুণসম্পন্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে ৷” তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু আমিই যে বঙ্গবন্ধুকে কবি বলেছি, তা কিন্তু নয়৷ পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে বলেছে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ ৷ তাঁর ভাষণ শুনে নিউজ উইক তাঁকে পোয়েট অব পলিটিক্স বলেছে, কারণ, তাঁর ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো ৷” নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘‘একজন কবি মানুষের মনের কথা বললেন কিনা তা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ নয় ৷ তিনি কিভাবে বলেন, কোন ঢংয়ে বলেন, তা অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ ৷ মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র মেঘনাধবধ কাব্য মানুষের মনের কথা নয়, তবে বলার ঢংয়ে তা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে ৷ আর বঙ্গবন্ধু’র ভাষণে তাঁর নাটকীয়তা এবং সম্মোহনী কথা বলার স্টাইল ছাড়াও যুক্ত হয়েছে মানুষের মনের কথা বলার বিষয়টি ৷
তিনি ৭ মার্চের বক্তৃতায় মানুষের মনের কথা বলেছেন ৷ আশার কথা বলেছেন ৷ আর সে কারণে এখনো তাঁর সেই বক্তৃতা মানুষকে উজ্জীবিত করে ৷ পৃথিবীর কোনো নেতা ১০ লাখ মানুষের মাঝে এরকম উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছেন বলে আমার জানা নাই ৷ আজো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে তাঁর ভাষণ বেঁচে আছে ৷ থাকবে ৷ তাই এটা অমর কবিতা ৷ আর সেই কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৷” বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নানা দিক বিশ্লেষন করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ ৷ তাঁর বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুরর ৭ মার্চের ভাষণের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর সেগুলো হলো: ১.বাঙালির সংগ্রাম ঐহিত্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, ২. গণতান্ত্রিক চেতনা, ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ৪. শান্তির বাণী, ৫. মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ৬. আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ৷ তিনি বলেন, ‘‘এই একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন ৷ কিন্তু তা সহিংস নয় ৷ তিনি শান্তিপূর্ণ আলোচনার কথা বলেছেন ৷ অহযোগের কথা বলেছেন, আবার সবাইকে মাসের এক তারিখ গিয়ে বেতন আনতে বলেছেন ৷ তাঁর এই একটি বক্তৃতা একটি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছে ৷ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৷ আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিরোধ সংগ্রাম হয়নি ৷ একটি ভাষণেই পুরো দিক নির্দেশনা ছিল ৷
একটি ভাষণের এই অর্জন এবং গুণাবলী বিশ্বের আর কোনো ভাষণের আছে বলে আমার জানা নাই৷” ‘‘বিশ্বজনীনতা এবং মানবিক গুণের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে ৷ তিনি যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে কথা বলেনছেন এটা সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার ৷ তাই সারবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন ৷
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের সার্বজনীন অধিকার৷”
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো৷”- এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না ৷ তিনি বলেছেন, এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের ৷ তিনি পার্টির নেতা-কর্মীদের বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয় ৷ অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘‘এটা তাঁর মানবিকতা এবং অসাম্প্রদয়িক চরিত্রের প্রকাশ৷” তিনি আরো বলেন, ‘‘৭ই মার্চের ভাষণের বড় শিক্ষা হলো কোনো জাতিকে তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না ৷ বন্দুকের নল বা অস্ত্রের মুখে ‘দাবায়ে’ রাখা যায় না ৷
এটাই বিশ্বজনীন সত্য৷” এদিকে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার এক বাণীতে বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল আমাদের নয়, বিশ্ববাসীর জন্যই প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে৷” তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ৷ একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ৷” আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই স্বীকৃতি৷” তিনি বলেন, ‘‘বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন ৷
বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র ৷ কালজয়ী এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে ৷ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি ৷ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ছিনিয়ে আনি মহান স্বাধীনতা, বাঙালি জাতি পায় মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ ৷ প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ৷” বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে ‘‘লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড-এর বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ বইয়ে এই ভাষণ স্থান পেয়েছে ৷ অসংখ্য ভাষায় অনুদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ৷” বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ৭ই মার্চের অমর বাণী স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালির নানা সংকটে, সংগ্রামে জাতিকে বার বার পথ দেখিয়েছে।
সাহস জুগিয়েছে নবতর স্বপ্নে বুক বেঁধে পথ চলার। বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী বাণী দূর করে দেয় সকল বিভ্রান্তি আর আপসের ষড়যন্ত্র। তাই এই ভাষণ বিশ্বের সর্বাধিকবার প্রচারিত ও শ্রবণকৃত অলিখিত ভাষণ। সহস্র যুগেও বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের এই ভাষণের আবেদন ও প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরাবে না ।
স/বি