স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বাঘারপাড়ার ভ্রাম্যমাণ চাওয়ালা এমরান
আজম খাঁন, বাঘারপাড়া (যশোর) : স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন যশোর-নড়াইল সড়কের ধলগ্রাম রাস্তা মোড়ের ভ্রাম্যমাণ চাওয়ালা এমরান হোসেন।
সকাল থেকে রাত ১০টা অবধি তাকে দেখা যায় বাঘারপাড়ার ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ের বাজারে দু’টি নাইলনের থলে হাতে নিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে গিয়ে ভ্রাম্যমাণভাবে চা বিক্রি করতে।
তার থলের একটিতে চায়ের ফ্লাস্ক ও চিনির বৈয়াম, অন্যটিতে বিস্কুট ও কেকের দুটি প্লাষ্টিকের বৈয়াম ও ওয়ানটাইম চায়ের কাপ এবং পানির বোতল দেখা যায়। তিনি যশোর – নড়াইল মহাসড়কের ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ে (শিশু গাছের নিচে) বসে থাকেন ফোন কলের অপেক্ষায়।
ফোন কল পেলেই ছুটে যান সেই চা পিপাসু মানুষের কাছে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এভাবেই চলে তার ভ্রাম্যমান চা বিক্রি চলে। প্রতিদিন ৩ থেকে ৬ হাজার টাকার চা বিক্রি করেন বাঘারপাড়ার জামদিয়া ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের ইমরান হোসেন। ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ের সকল দোকানদারগনই এমরানের চা পছন্দ করেন।
ব্যবসায়ী রাজিব আহম্মেদ জানান, “এমরানের চায়ের সাদই আলাদা!! আমরা এধরণের সাধ কোন কোন দোকানের চায়ে পাই না। এছাড়া খরিদ্দার অথবা কোন মেহমান আসলে দোকানে বসেই চা আপ্পায়ন করা সভব হয় বলে বেশিরভাগ দোকানদারই এমরানের চায়ের ভক্ত।
বাবা ইউসুফ কাজীর ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় হলেন ইমরান হোসেন। ইউসুফ কাজীর ৭ বিঘা জমি থাকলেও ইমরান শুধু বসবাসের জন্য ৬ শতাংশ জমি পায় পৈত্রিক সূত্রে। সেখানে স্ত্রী ইয়াসমিন খাতুন ও তিন সন্তানকে নিয়ে একটি টিনের ঘরে বাস করেন ইমরান।
বড় ছেলে আরাফাত হোসেন (১০), মেয়ে জামেলা (৫) ও ছোট মেয়ে লিতুনজিরা (৩) স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। কোনো প্রকার সরকারি সহায়তা ছাড়াই ইমরান হোসেন সন্তানদের লেখাপড়াসহ পরিবারের যাবতীয় খরচ মেটায় এই চা বিক্রির অর্থ দিয়ে।
গত ৪ জুলাইসেঙ্কো যশোর-নড়াইল মহাসড়কের ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ে কথা হয় এ ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা ইমরানের সাথে। তিনি বলেন, বিয়ের পরপরই বাবা ইউসুফ কাজী পরিবার থেকে আলাদা করে দেন ইমরানকে। এরপর ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ে নূর ইসলামের চায়ের দোকানে দৈনিক ৩২০টাকা হাজিরা ভিত্তিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ নেন তিনি।
ভালোই চলছিলো ইমরানের সংসার। এরপর আসে ভয়াল করোনা মহামারি। স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। জনশূণ্য হয়ে যায় স্থানীয় হাট বাজার। এর প্রভাব পড়ে নূর ইসলামের চায়ের দোকানেও। একদিন মাইকিং করে চায়ের দোকানটি বন্ধ করে দেন স্থানীয় প্রশাসন।
ইমরান হোসেন বেকার হয়ে যান। সংসার আর চলে না। এই চরম মূহুর্তে স্থানীয় মুরুব্বীদের পরামর্শে ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা হয়ে যান ইমরান। এজন্য স্ত্রী ইয়াসমিনের পোষা ছাগলটি ৮হাজার ৮শত টাকায় বিক্রি করে একটি ফ্লাস্ক (চা গরম রাখার প্রাত্র), একটি বৈদ্যুতিক কেতলি (পানি গরম করার যন্ত্র), চা, চিনি, বিস্কুট, কেক, পানির বোতল ও ওয়ান টাইম চায়ের কাপ কিনে শুরু করেন চা বিক্রি।
প্রথম দিকে চা নিয়ে ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করতেন। আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়লে মোবাইল ফোনে কল করতেন চা পিপাসুরা। সে সময় ফোন রিসিভ করে স্থান চিহ্নিত করলেও এখন আর ফোন রিসিভ করেন না ইমরান। কল আসলেই বুঝতে পারেন কে ফোন করেছেন। ফোন কলটি কেটে দিয়ে ছুটে যান সেখানে।
এভাবে প্রতিদিন ১হাজার থেকে ১২শ কাপ চা ৫টাকায় বিক্রি করেন। সাথে কেক বিস্কুটও বিক্রি করে থাকেন। এর থেকে প্রতিদিন আয় করেন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে এক হাজার থেকে ১৫শ টাকা লাভ থাকে ইমরানের। বাজার থেকে মাত্র ১০০ মিটার উত্তর পাশেই তাঁর বাড়ি। বাড়িতেই চলে পানি গরমের কাজ।
চায়ের ফ্লাস্ক শেষ হলে বাড়িতে চলে যান ইমরান। ফ্লাস্কে গরম চা ভরে নিয়ে আবার চলে আসেন বাজারে। ৬০ থেকে ৬৫ কাপ চা থাকে ফ্লাস্কে। ভোর ছয়টা থেকে রাত ১০টা বা সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলে তাঁর চা বিক্রি। এখন ইমরানের ৫টি ফ্লাস্ক, ১টি গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার, দুটি বৈদ্যুতিক কেতলি আছে। ইমরান বলেন, প্রতিদিনের আয় দিয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন তিনি। ভবিষ্যতে যদি কোনো অনুদান পান তা দিয়ে বড় একটি স্থায়ী দোকান করতে চান তিনি।
সেখানে বেকারি পণ্য থেকে শুরু করে চা কফিও বিক্রি করবেন। এরপর আস্তে আস্তে জমি ও বাড়ি বানাবেন। এভাবেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা ইমরান হোসেন। জানা গেছে, যশোর নড়াইল মহাসড়কের ধলগ্রাম রাস্তার মোড়ের এই বাজারে চা, মিষ্টি, মুদি, মেশিনারিজ ওয়ার্কশপসহ ২শত ৬০ টি দোকান আছে। মুলত এসব দোকানেই ইমরান গরম চা সরবরাহ করে থাকেন।
এ বাজারের মিষ্টি বিক্রেতা আব্দুল হামিদ ইমরানের বিষয়ে বলেন,‘ আমি দিনে ১৫ থেকে ১৬ কাপ চা পান করি। এছাড়াও যদি দোকানে অতিথি আসেন তবে ইমরানকে ফোন দিলে সঙ্গে সঙ্গে সে চা দিয়ে যায়। এতে আমার অনেক সময় বাঁচে। তিনি আরও বলেন, ইমরানের চায়ের স্বাদই আলাদা। একারনে ইমরানের চা খাই’।
এমরান এই বাজারের প্রত্যেকের মোবাইল নম্বরের শেষ তিন চার সংখ্যা মুখস্ত রাখতে পেরেছে। তার কাছে চায়ের জন্য মোবাইল ফোন করলেই তা কেটে দিয়ে পৌঁছে দেন চা। এতে চা পানকারীর অযথা পয়সা ব্যয় হয় না। গরীব মানুষ সে। তঁার সন্তানেরাও লেখাপড়া শিখছে।
সরকারে যদি কোনো খাত থাকে তবে তা বরাদ্দের দাবি জানান’। উপজেলার জামদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল রইসলাম তিব্বত বলেন,‘ ইমরানের বিষয়টি জানা ছিলো না। ও (ইমরান) যদি ইউনিয়ন পরিষদে এসে দেখা করে তবে কিছু করা যেতে পারে’।
স/এষ্