ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর ২০২৫
  1. Bangla
  2. chomoknews
  3. English
  4. অপরাধ
  5. অভিনন্দন
  6. আমাদের তথ্য
  7. কবিতা
  8. কর্পরেট
  9. কাব্য বিলাস
  10. কৃষি সংবাদ
  11. খুলনা
  12. খোলামত
  13. গল্প
  14. গাইড
  15. গ্রামবাংলার খবর
আজকের সর্বশেষ

সুন্দরবনে ২০ বনদস্যু বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বনজীবীরা আতঙ্কে,গত তিন মাসে ৩ শতাধিক জেলে অপহরণ

চমক নিউজ বার্তা কক্ষ
অক্টোবর ৩০, ২০২৫ ৫:৪১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সুন্দরবনে ২০ বনদস্যু বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বনজীবীরা আতঙ্কে,গত তিন মাসে ৩ শতাধিক জেলে অপহরণ

এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির,সুন্দরবন থেকে ফিরে।। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্যসুন্দরবনে আবারো বেড়েছে দস্যু আতঙ্ক। দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের কারণে দস্যু আতঙ্ক কাটিয়ে কিছুদিন হাঁপ ছেড়েছিল সুন্দরবন।

স্বস্তি ফিরেছিল বনের উপরে নির্ভরশীল মানুষের জীবনে। সুন্দরবনে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বনদস্যু বাহিনী। গত ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণকারী এবং নতুনভাবে সংগঠিত দল মিলিয়ে অন্তত ২০টি দস্যু বাহিনী এখন সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা, চাঁদপাই ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তাদের দৌরাত্ম্য বেশি।

এসব দস্যু জেলেসহ বনজীবীদের অপহরণ করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করছে।গত তিন মাসে ৩ শতাধিক জেলে অপহরণ করে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে তারা। এতে জেলে ও তাদের পরিবার, বনজীবী ও ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। জেলে ও বনজীবীরা দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন- সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে।

মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া তিন শতাধিক জেলে বনদস্যুদের হাতে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর শতাধিক জেলেকে জিম্মি করে বনদস্যুরা। এর মধ্যে অনেকেই গোপনে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে ফিরে এসেছে। এখনও বিভিন্ন বাহিনীর হাতে জেলেরা জিম্মি আছেন বলে জানান- মৎস্য ব্যবসায়ীরা।

পূর্ব-সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, তেঁতুলবাড়িয়া, টিয়ার চর, আন্ধারমানিক, পশুর, শিবশাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলদস্যুদের বিচরণ বেশি। দস্যুরা বিভিন্ন নামে দল গঠন করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আগের আত্মসমর্পণকারী বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাহিনীগুলো।

এসব বাহিনীর মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মনজুর বাহিনী, দাদা ভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্য সংখ্যায় বেশি ও দুর্ধর্ষ। এই তিন বাহিনীর সদস্যরা আগে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছিল। এ ছাড়া করিম-শরিফ বাহিনী, আসাদুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙ্গাবাহিনী, সুমন বাহিনী, আনোয়ারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনীর নাম উল্লেখযোগ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনসংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি দস্যুদের মধ্যস্থতাকারী ও সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। তারা অপহৃত হয়ে জিম্মি থাকা জেলেদের পরিবার ও তাদের মহাজনদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে চাঁদার টাকা আদায় করে দস্যু বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন দস্যু বাহিনী নিজ নিজ সংকেত বসানো টোকেন দিচ্ছে জেলেদেরকে। জলদস্যুর দেয়া টোকেন সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনে যেকোনো জায়গায় মাছ ধরলে তারা নিরাপদ থাকে। টোকেনের মাধ্যমে সুন্দরবনে মাছ ধরার অনুমতি পায়।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানান, দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা নিরাপদ নয়। বন সংলগ্ন জেলে মৎস্য আড়তের আশপাশে দস্যুদের প্রতিনিধি বা সোর্স ঘোরাফেরা করে। তথ্য ফাঁসের বিষয়ে জানতে পারলে পরবর্তীতে বনে গেলে জেলেদের উপরে বাড়ে নির্যাতন ও চাঁদার অঙ্ক। এই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেলে বা মহাজন কেউ-ই মুখ খুলছেন না।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য- বনে জেলেদের পাঠালে নৌকা প্রতি ২৫-৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অপহরণের ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হয় ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। তবে কোস্টগার্ডের সাাঁশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এতে তৎপরতা কমেছে বনদস্যু বাহিনীর। স্বস্তি ফিরেছে উপকূলের বনজীবীদের মাঝে।

বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, সুন্দরবনের বনদস্যুরা কয়েক দফায় আত্মসমর্পণ করে আলোর পথে ফিরেছিল। ২০১৬ সালে সুন্দরবনের সাতটি বনদস্যু দল একসঙ্গে আত্মসমর্পণ করে। সে সময় ৩২ জন বনদস্যু অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অঙ্গীকার করে। এরপর ২০১৮ সালের পহেলা নভেম্বর ৯টি বনদস্যু বাহিনীর ৫৭ জন বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে।

পরে আরেক দফায় ২০১৯ সালের পহেলা নভেম্বর আরও ২৫ জন বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে। শতাধিকের বেশি বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, যার কারণে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। তবে গত তিন মাসে জেলে বাওয়ালীদের অপহরণের মতো ঘটনাগুলো আবারো জানান দিচ্ছে সুন্দরবনে নতুন দস্যু বাহীনির উত্থান ঘটেছে।

সূত্র বলছে, গত তিন মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০ জনেরও বেশি জেলে ও মৌয়াল অপহরণের শিকার হয়েছেন। মুক্তিপণের জন্য তাদের কাছে দাবী করা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে কোস্ট গার্ড সফল অভিযানের মাধ্যমে জেলে বাওয়ালিদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

কোস্ট গার্ড মংলা পশ্চিম জোনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনের দস্যুদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এরপর থেকে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দস্যু দমনে অভিযান এবং তাদের অবস্থান শনাক্তকরণে গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছে।

গত ৩রা অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্ট গার্ড। এসব অভিযানে রাঙ্গা বাহিনীর প্রধানসহ ৪৪ জন বনদস্যু এবং তাদের সহযোগীদের আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র ৪৩টি বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে।

বনদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ৪৮ জেলেকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট একাধিক জেলে ও বনজীবীরা বলছেন, বর্তমানে বিভিন্ন নামে নতুন বনদস্যু বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে করিম শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনীসহ অন্তত ৫/৭টি ডাকাত দল রয়েছে। নৌকায় করে এসব বনদস্যুরা সুন্দরবনের গহীনে অবস্থান করে।

বনের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে এদের ডেরা। সুযোগ বুঝে এই বনদস্যুরা কখনো মাছ ধরার ট্রলার কিংবা বনজীবীদের জিম্মি করে। অপহরণের পর বনদস্যু বাহিনীর ডেরায় নিয়ে করা হয় অমানুসিক নির্যাতন। অনেকেই মুক্তিপণ দিয়ে সেখান থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

বনদস্যু বাহিনীর হাতে অপহরণের শিকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলে বলেন, ‘সুন্দরবনের যে কয়টি দস্যু বাহিনী এই মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে তার মধ্যে দয়াল বাহিনী অত্যন্ত দুর্ধর্ষ। এই বনদস্যুরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মাছ ধরার ট্রলারে হামলা করে অপহরণ করে। এরা এতটাই কুখ্যাত যে মুক্তিপণের টাকা না দিলে নির্মম নির্যাতন চালায়। এরা কেউকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না’।

সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলে, বনদস্যুরা সাধারণত বনজীবী কিংবা জেলে বাওয়ালিদের ছদ্মবেশে সুন্দরবনের প্রবেশ করে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ে। এসব বনদস্যুদের ডাটাবেজ তৈরি করে তাদেরকে ডিজিটালাইজড করতে হবে, যাতে সহজেই তাদেরকে চিহ্নিত করা যায়। এসব দস্যুদের চিহ্নিত করে তাদের সুন্দরবনে যাওয়া আটকাতে হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে এবং পরিবারের প্রতিও নজর রাখতে হবে।

সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল এবং নজরদারি বাড়াতে হবে। তাদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি শুধু একটি নিরাপত্তার ইস্যু নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ও এর উপর নির্ভরশীল মানুষের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

এদিকে গেল ১০ এপ্রিল সুন্দরবনের গহীন হতে বনদস্যু করিম শরীফ বাহিনীর জিম্মি থেকে ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এর আগেও অস্ত্রসহ কয়েকজন দস্যুকেও গ্রেপ্তার করে কোস্টগার্ড।

কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. মাহবুব হোসেন বলেন, বিগত দিনে সুন্দরবনের দস্যুতা দমনে কোস্ট গার্ড যেমনি তৎপর ছিল, তেমনি বর্তমানেও রয়েছে, আগামীতেও এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

পূর্ব-সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে যেভাবে দস্যুদল হানা দিতে শুরু করেছে, তাতে শুঁটকি মৌসুমে দুবলাসহ বিভিন্ন চরে তাদের নির্ধারিত রেভিনিউ যে ৮ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে তা ব্যাহত হতে পারে। তিনি দস্যু দমনে ঊর্ধ্বতন মহলকে বিষয়টি অবহিত করেছেন।

সুন্দরবন খুলনা বিভাগীয় বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, সুন্দরবন সুরক্ষায় বন বিভাগের দায়িত্ব অপরিসীম। বাঘ, হরিণসহ সকল বন্যপ্রাণী রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু যে সকল দস্য বাহিনী সুন্দরবনে রয়েছে, তাদের দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাব, কোস্ট গার্ড-এর ওপর সরকার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।