খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলসমূহের শিক্ষা ও শৃংখলাবোধ এবং একজন ব্রাদার জয়ন্ত এন্ড্রু কস্তা
ভিকটর কে. রোজারিও : জন্মগতভাবে খ্রিস্টান পরিবারের সদস্য এবং মিশনারি স্কুল ও কলেজের ছাত্র হিসেবে মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে কিছু ধারণা আমার আছে। সেই থেকেই জানি, আইন-শৃংখলা, নিয়মানুবর্তিতার বিষয়ে তারা অত্যন্ত কঠোর।
সে কারণেই এ দেশের বহু মানুষ বাড়ির কাছের নামকরা স্কুল-কলেজ রেখে মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়তে পাঠান। এর উদাহরণ মফস্বল এলাকার স্কুলগুলোতে গেলে দেখা যায়। কষ্ট স্বীকার করে পায়ে হেটে, সাইকেলে চেপে মফস্বলের ছেলে-মেয়েরা আট-দশ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে আসে রোজ।
সেখানকার অভিভাবকরা বিশ্বাস করেন, মিশনারি স্কুলে পড়লে তাদের সন্তান সুশিক্ষিত হবে। আদব-কায়দা, নিয়মানুবর্তিতা, নিজ, পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্র-জগত-প্রকৃতি সম্পর্কে দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ তাদের সন্তানদের বিদেশে পড়তে পাঠান। ভর্তি করেন মিশনারি স্কুলে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুজ্জামান চৌধুরী রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তাঁর সন্তান মাহী বি. চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম পাক্ষিক প্রকীর্তিও জন্য।
প্রসঙ্গত আলাপে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি আমেরিকায় ক্যাথলিক (মিশনারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন, তাঁর পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন যে, মিশনারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের মধ্যে সুস্থ জীবনবোধ ও শৃংখলা তৈরি করে দেয়।
এ নিয়ে সব সময়ই একটা সম্মানবোধ কাজ করে নিজের ভেতর। দেশের বিভিন্ন এলাকায়, যেখানে মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, সবখানেই সেগুলোর সুনাম আছে। ঢাকার নটরডেম কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়, হলিক্রস কলেজ, সেন্ট যোসেফস, গ্রিন হ্যারাল্ড, সেন্ট গ্রেগরি, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স, ময়মনসিংহের নটরডেম কলেজ, বার বার দেশসেরা কুমিল্লার আওয়ার লেডি অব ফাতিমা, কালিগঞ্জের তুমিলিয়ার সেন্ট মেরীস, নাগরীর সেন্ট নিকোলাস, বান্দুরার হলিক্রস, হাসনাবাদ-গোল্লার সেন্ট থেকলা, বক্সনগর হাইস্কুল, নাটোরের বনপাড়ার, সেন্ট যোসেফস, জোনাইলের সেন্ট লুইস, সেন্ট মেরীস, পাবনার চাটমোহরের সেন্ট রীটা’স, দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস, খুলনার সেন্ট যোসেফস, বাগেরহাট-মোংলার সেন্ট পলস, চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড, সেন্ট স্কলাস্টিকা ইত্যাদি বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শতাধিক বছর ধরে জ্ঞানের আলোকিত বিতরণ করছে স্থানীয় সাধারণ খেটে-খাওয়া শ্রমজীবি মানুষের সন্তানদের মধ্যে। এরকম আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে দেশজুড়ে।
এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে আলোকিত জীবন গড়েছেন কত কত মানুষ। জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের বিরাট অংশ এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলনীতি ‘শিক্ষার জন্য এসো, বিতরণের জন্য যাও’ আদর্শে দীক্ষিত হয়ে নানা পেশায় আন্তরিকতার সাথে আন্তর্জাতিক, জাতীয়, স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়ম-শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতে তাদেরকে কতটা বেগ পেতে হয়েছে, স্থানীয় ক্ষমতা ও দাপটশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে হয়েছে, কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে হয়েছে। নানা স্থানে সম্মানিত শিক্ষকগণ ছাত্র, তাদের অভিভাবকের হাতে হেনস্থার শিকার হয়েছেন, পিটুনী খেয়েছেন। ক্রমে, কালে কালে স্থানীয়রা বুঝেছেন এসব নিয়ম-কানুনের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা। সর্বক্ষেত্রে এখনও যে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি তার নানা খবর, নজীর এখনও আমরা পাই।
গতকাল বাগেরহাটের মোংলার সেন্ট পলস্ স্কুলের একটি খবর দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলোতে এসেছে। যা আমাকে আহত এবং ব্যথিত করেছে।
সারাবাংলা.নেট- এ খবরটির শিরোনাম ছিলো : ‘নির্ধারিত জুতা না পরায় শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুল ছাড়া’।
সংবাদমাধ্যমটির মোংলা (বাগেরহাট) এর লোকাল করেসপন্ডেন্ট- এর বরাতে খবরটি ছিলো এমন : ‘নির্ধারিত জুতা পরে না আসায় মোংলায় সেন্টপলস্ হাই স্কুলের ক্লাস থেকে শতাধিক ছাত্র- ছাত্রীদের বের করে দিয়েছেন শিক্ষকরা। মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টায় স্কুলের ক্লাস রুমে প্রবেশ করলে শিক্ষকরা সব ছাত্রদের ড্রেস ও জুতা চেক করেন। এসময় সবার গায়ে স্কুল ড্রেস থাকলেও অনেক ছাত্রের পায়ে জুতা ছিলো বিভিন্ন রঙয়ের।’
খবরে আরও বলা হয়, ‘এসময় ক্লাস শিক্ষকরা ড্রেসের সঙ্গে মিল না থাকা ওই সব শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম থেকে বের করে দেন। এমনকি বৃষ্টির মধ্যেও তাদের স্কুল বাউন্ডারি ছাড়া করা হয়। ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ কেউ বাড়ি ফিরে গেলেও অনেককেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।’
‘বিষয়টি জানতে পেরে মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আনোয়ার উল কাদির ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ক্লাস শুরুর এক ঘণ্টা পর গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত এন্ড্রু কস্তা সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।’ খবরের বাকী অংশ, ‘তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন ক্লাস শিক্ষক জানান, প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত এন্ড্রু কস্তা নতুন যোগদান করার পর নিজের ইচ্ছামতো স্কুলের সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। করোনাকালীন মানবিক সব কিছু তিনি ভুলে গেছেন।
মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার জানান, বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরে যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল তারা ক্লাস করতে পেরেছে।’
সেন্ট পলস্ স্কুলের প্রধান শিক্ষক যা করেছেন, তা আমি সমর্থন করি না। এটা ন্যায়সঙ্গত হয়নি বলেই আমি মনে করি। আমি অবশ্যই বিদ্যালয়ের নিয়ম-শৃংখলার পক্ষে। কিন্তু সময়, পরিস্থিতি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
ভয়াবহ মহামারীতে পৃথিবী বিপর্যস্ত, মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক জীবন লণ্ডভণ্ড, তছনছ হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি এ দেশে দেড়যুগ শিক্ষতা করা মানুষ এখন সংসার চালাচ্ছেন সবজি বেচে। এক শিক্ষক চায়ের দোকানদার। খুলনার এক কিন্ডার গার্টেনের মালিক-শিক্ষক সাইকেলে বয়ে বাড়ি বাড়ি গ্যাস সিলিন্ডার বেচেন।
বদলে গেছে কত মানুষের পেশা। বড় বড় ব্যবসায়ী পথে বসে গেছেন। এসব আমরা কম-বেশি সবাই জানি। আমরা এও জানি দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ। পাঠদান থেকে বঞ্চিত এ দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী। অনলাইনে পাঠদানের যে চেষ্টা হয়েছে, তা কতটা সফলতার মুখ দেখেছে সে আলোচনায় না-ই বা গেলাম। গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষার সাথে, বইয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক হারিয়েছে।
তাদের ব্যাগ ছিঁড়ে গেছে কিংবা পুরোনো হয়ে গেছে, জুতা ছিঁড়ে গেছে নইলে ছোট হয়ে গেছে, জামা আঁটো হয়ে গেছে। কারণ শিশুরা দেড় বছরে বড় হয়েছে শারীরিকভাবে। হঠাৎ স্কুল খোলায় তারা ঘরের নানা জায়গা থেকে খুঁজে বই বের করেছে। বের করে দেখে তাদের ব্যাগ ইঁদুরে কাটা, জামা হয় না, জুতা ফাটা। এই শিক্ষাবর্ষে হাতে সময় আছে মাত্র দুইমাস। তাও এখনও অনিশ্চিত। করোনার প্রকোপ বাড়লে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়ে রেখেছেন।
আমার সন্তানদের স্কুল ব্যাগ ছিঁড়ে গেছে। বলেছি আর ক’দিন সবুর করতে। করোনায় আমি সাত মাস কর্মহীন ছিলাম। তার আগে হাসপাতালে চিকিৎসায় খরচ লেগেছে। সাত মাসে পরিবারের খরচের ঘোড়া তো থেমে থাকেনি। এখন বেতন পাই এ মাসেরটা পরের মাসের শেষে। তাও অর্ধেকপ্রায়। চারপাশে খোঁজ নিয়েই জানি, এর চেয়ে খুব বেশি ভালো দেশের বেশির ভাগ মানুষই নেই।
জানি না সেন্ট পলস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রাদার জয়ন্ত এন্ড্রু কস্তা কোন বিবেচনায় এমনটি করলেন। কেন তিনি এতটা অমানবিক হলেন? শৃংখলা রক্ষায়? এানুষের জীবনে কোনটি আগে, জীবন, শিক্ষা না কি জামা-জুতা-স্কুলব্যাগ? তিনি তো এ দেশেই বসবাস করেন, এ দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি তার জানা।
মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আনোয়ার উল কাদির ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি যদিও ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নিয়েছেন। সবাই কি ফিরতে পেরেছিলো? তিনি আরও একটি অসৌজন্যমূলক কাজ করেছেন।
উদ্ধৃত সংবাদ থেকেই পাচ্ছি, এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সংবাদকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দেননি। সংবাদ শিরোনাম না হয়ে বরং বিষয়টিকে নিষ্পত্তি করা যেতো, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ভবিষ্যতে আরও দায়িত্বশীলতার প্রতিশ্রুতিতে।
করোনা আমাদেরকে নতুন করে অনেক কিছু শিখিয়েছে, শেখাচ্ছে। মানুষ তার স্মরণকালের ইতিহাসে এমন দুর্যোগ দেখেনি বলে জানাচ্ছেন বিশ্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সংস্থা। বলা হচ্ছে, করোনায় আপাত বা দৃশ্যত যে ক্ষতি আমরা হিসেব করছি, মহামারীর সামগ্রিক হিসেবে এটা তার সিঁকি ভাগও নয়।
এখন পর্যন্ত আমরা কেবল করোনা আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু দেখছি। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাব দেখতে হবে যুগের পর যুগ। সেই প্রভাবে কত মানুষের প্রাণ যাবে ক্ষুধা-দারিদ্র্যে তা কেউ অনুমানও করতে পারবে না।
অনুরোধ রাখছি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি, আপনারা ছাত্র-ছাত্রীদেও প্রতি আরও সংবেদনশীল হোন, মানবিক আচরণ করুন। শিক্ষা জীবনের সমস্ত কিছুর থেকে গুরত্বপূর্ণ, কিন্তু জীবনের থেকে বেশি প্রয়োজনীয় নয়।
স/এষ্