বিশ্বকাপ শেষে কি পেল বাংলাদেশ
রাহুল রাজ ।। বার্বাডোজের মাঠে ফাইনালের স্নায়ুক্ষয়ি ম্যাচে হারতে হারতে জিতে গেল রোহিত শর্মার ভারত। অন্যভাবে বলা যায় জেতা ম্যাচ হেরে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রমান করলো তারা চোকার্স, চাপে ভেঙে পড়া এক চিরায়ত সত্য তাদের ক্রিকেট ইতিহাস।
দীর্ঘ ১৭ বছরের শিরোপা খরা দুর হলো ভারতীয় ক্রিকেট দলের। গত ৪/৫ বছর ধরে ভারত ধারাবাহিকভাবে ভালো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু নকআউট স্টেজে গিয়ে দলটি শেষ বাধা পেরুতে পারছিলনা। আইসিসি টেষ্ট চ্যাম্পিয়নশীপ, একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপ, টি২০ বিশ্বকাপ কোন ট্রফিতেই হাত ছোঁয়াতে পারছিলনা তারা।
২০১৩ সালে সর্বশেষ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতার পর, আর কোন আইসিসি ইভেন্ট জেতা হয়নি দলটির। একাধিকবার তারা কাছাকাছি গেলেও শেষ রক্ষা করতে পারছিলনা। বিশ^কাপ ও বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে চমক নিউজের মুখোমুখি হন জাতীয় ক্রীড়া ভাষ্যকার, ও ক্রীড়া বিশ্লেষক মো: সামসুল ইসলাম।
তিনি জানান, অবশেষে ২৯ জুন ২০২৪ ভারতের জন্য এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, প্রায় ফসকে যাওয়া ম্যাচে দারুণভাবে ফিরে এসে ৭ রানের জয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করে ২য় টি২০ বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলেছে ভারত। ক্রিকেটের দুই সুপারস্টার ভিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মা তারা জানতেন, এটাই আমাদের শেষ সুযোগ।
রোহিত নিয়মিত রান করছিলেন কিন্তু কোহলি নিজেকে খুঁজে ফিরছিলেন। ফাইনালের বড় মঞ্চের জন্যই বুঝি অপেক্ষা করছিলেন এই ধ্রুপদী ব্যাটার। টস জিতে নির্ভার ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত ভালই ছিল।
শুরুতেই ৩ উইকেট হারিয়ে ভারতের টালমাটাল অবস্থা, হাল ধরলেন কোহলি, আর সাথে কোচের সাহসী সিদ্ধান্তে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে নিজের জাত চেনালেন অক্ষর প্যাটেল (৩১ বলে ৪৭ রান)। ভারত ফিরে এলো ম্যাচে।
তরুণ শিভাম ডুবে যুক্ত হলেন কোহলির (৫৯ বলে ৭৬ রান) সাথে, তাঁর ১৬ বলে ২৭ রানের দারুণ ইনিংসে ভারত ৭ উইকেটে ১৭৬ রানের লড়াই করার মতো পুঁজি পেল। দক্ষিণ আফ্রিকার নরকিয়া এবং মহারাজ পেলেন ২টি করে উইকেট।
রান তাড়ায় প্রোটিয়ারাও শুরুতেই হোঁচট খায়। ১২ রানে ২ উইকেট হারিয়ে তারাও বিপদে, কিন্তু এটাতো ফাইনাল এতো সহজে কি শিরোপা পাওয়া যায়? দাঁড়িয়ে গেলেন ডি কক, আর সাথে পেলেন ক্লাসেন, স্টাবস এবং ডেভিড মিলারকে।
২৭ বলে ৫২ রানের ঝড়ো ইনিংসে ম্যাচ বের করে নিচ্ছেন ক্লাসেন। ৩০ বলে ৩০ রান, ২৪ বলে ২৬ রান হাতে তখনও ৬ উইকেট, ১৮ বলে ২২ রান হাতে ৫ উইকেট। ১২ বলে ২০ রান হাতে ৪ উইকেট, মিলার তখনো আছেন। আর্শদ্বীপ সিংয়ের ১৯তম ওভারে এলো মাত্র ৪ রান।
শেষ ৬ বলে প্রয়োজন ১৬ রান। হার্ডিক পান্ডিয়া বল করলেন মিলারের বিপক্ষে, তিনি উড়িয়ে মারলেন লং অনের উপরে। সবার ধারণা ৬ হচ্ছে, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে স্র্যুকুমার যাদব অতী মানবীয় এক ক্যাচ ধরে দক্ষিণ আফ্রিকার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন। এটি শুধু টুর্ণামেন্টের সেরা ক্যাচই নয় বরং এটা ছিল শিরোপা জয়ী ক্যাচ। ভারতের জয় ৭ রানের।
এতো সহজ সমীকরণ মেলাতে না পেরে কান্নায় ভেংঙে পড়েন চোকার্স খ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড়েরা। শেষ হলো ৪ ঘন্টাব্যাপী এক থ্রিলার মুভি। দ্যা ওয়াল খ্যাত ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ভদ্রলোক রাহুল দ্রাবিড়কে অসাধারণ এক ফেয়ারওয়েল জানালেন পুরো ভারতীয় দল।
শিরোপা জয়ের চেয়ে আনন্দের আর সেরা উপহার কি বা হতে পারতো তাদের জন্য। সাজানো মঞ্চে একে একে আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন কোহলী, রোহিত এবং রবিন্দ্র জাদেজা। তারা ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন কখন, কোথায় থামতে হয়।
আইসিসি এবারই প্রথম সর্বাধিক ২০টি দল নিয়ে দুটি ভিন্ন দেশে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রে) টি২০ বিশ্বকাপের ৯ম আসর আয়োজন করেছিল। মো: সামসুল ইসলাম আরো জানান, ক্রিকেটের বিশ্বায়নের কথা মাথায় রেখে সাজানো এই ইভেন্ট দারুণ সফল হয়েছে।
নেপাল, পাপুয়া নিউ গিনি, উগান্ডা, কানাডা, নামিবিয়া, ওমানের মতো সহযোগি দেশগুলো বিশ্ব মঞ্চে সেরা দলগুলোর বিপক্ষে নিজেদের ক্রিকেট নৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছে। ৫টি করে দল নিয়ে ৪টি গ্রুপের রাউন্ড রবিন লীগ পর্বের ৪০ টি ম্যাচ, সুপার এইটের রাউন্ড রবিন লীগের ১২ ম্যাচ এবং ৩টি নকআউট ম্যাচসহ মোট ৫৫টি ম্যাচের মাসব্যাপী এই আয়োজন ক্রিকেট ভক্তরা বিশ্বব্যাপী দারুণ উপভোগ করেছে।
গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে দুই স্বাগতিকই উঠে এসেছিল সুপার এইটে। সাবেক চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের মতো দল গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্টের মতো দল চলে আসে সুপার এইটে। অষ্ট্রেলিয়াকে বিদায় করে সেমিতে জায়গা করে নেয় দূর্দান্ত ও লড়াকু আফগানিস্তান।
এগুলো সবই ছিল এবারের আসরের চমক। তবে দুটি সেমিফাইনালে একচেটিয়া লড়াই কারোই ভালো লাগেনি। দক্ষিণ আফ্রিকা আফগানিস্তানকে এবং ভারত ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে দাঁড়াতেই দেয়নি। দুই অপরাজিত দলের ফাইনাল অবশ্য স্নায়ুক্ষয়ি এবং উপভোগ্য ছিল। কি পেল বাংলাদেশ? এই প্রশ্নের উত্তরে মো: সামসুল ইসলাম জানান, আমাদের টি২০ ক্রিকেট ইতিহাসে বলার মতো সাফল্য এসেছে এই আসরেই।
আমরা সর্বাধিক ৩ ম্যাচ (শ্রীলঙ্কা, নেদারল্যান্ডস এবং নেপাল) জিতে সুপার এইটে এসেছিলাম। যদিও এখানে কোন ম্যাচেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারিনি। এমনকি শেষ ম্যাচে একটি অপ্রত্যাশিত সুযোগ এসেছিল সেমিফাইনালে যাবার, সেক্ষেত্রে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৭৩ বলে ১১৬ রান তাড়া করে জিততে হতো। আমরা সে চেষ্টাটাও ঠিকঠাক করতে পারিনি। আর এখানেই যেন সব সাফল্য ধুলোয় মিশে গেছে।
ব্যাটিং ইউনিট হিসেবে পুরোপুরি ফেইল করেছে বাংলাদেশ। তবে বোলিং ইউনিট হিসেবে অন্যতম সেরা ছিল এবারের বাংলাদেশ দল। রিশাদ হোসেন (১৪ উইকেট ও ৪০ রান) এবং তানজিম হাসান সাকিব (১১ উইকেট) ছিল সেরা আবিস্কার। তাসকিন (৮টি উইকেট) এবং মুস্তাফিজের (৮টি উইকেট) ফিরে পাওয়া ছন্দ আশাবাদী হওয়ার মতো।
ব্যাটিংয়ে একমাত্র তাওহিদ হৃদয় (১৫৩ রান) ছাড়া কেউ কোন ইম্প্যাক্ট রাখতে পারেননি। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ছিল ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন শান্ত (১১২ রান) এবং টপ অর্ডারের অধারাবাহিকতা। সাকিব (১১১ রান, ৩টি উইকেট) এবং মাহমুদুল্লাহ (৯৫ রান, ১টি উইকেট) প্রত্যাশামাফিক দলের চাহিদা মেটাতে পারেননি।
তাদের খেলায় বোঝা গেছে তারা ফুরিয়ে গেছেন। এই ফরমেটে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশ দলকে সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে পুনরায় শুরু করতে হবে শুরু থেকে। যদিও ২০২৬ এর পরবর্তি আসরে সরাসরিই খেলবে বাংলাদেশ। আসরের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় শীর্ষে ভারতের হার্ডিক পান্ডিয়া, আফগানিস্তানের রহমানুল্লাহ গুরবাজ, জাসপ্রিত বুমরাহ, মার্কাস স্টয়নিস এবং রোহিত শর্মা।
এরা নিজ নিজ দলের সাফল্যে সেরা ইম্প্যাক্ট রেখেছেন। সেরা ইম্প্যাক্ট ব্যাটারদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন রহমানুল্লাহ গুরবাজ, রোহিত শর্মা, ডি কক, ট্রাভিস হেড এবং ক্লাসেন। সেরা ইম্প্যাক্ট বোলারদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন জাসপ্রিত বুমরাহ, আর্শদ্বীপ সিং, কাগিসো রাবাদা, ফজল হক ফারুকী এবং আনরিখ নরকিয়া।
ফাইনাল ম্যাচের সেরা ভিরাট কোহলি এবং টুর্ণামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন জাসপ্রিত বুমরাহ। ব্যাটসম্যান ফ্রেন্ডলি টি২০ ফরমেটে বোলাররাও যে খেলেন, তারাওযে দলের জয়-পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহুর্তে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন।
এই আসরে পুরো টুর্ণামেন্ট জুড়েই তা প্রমানিত হয়েছে বারবার। আবারো দুবছরের অপেক্ষা, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার যৌথ আয়োজনে আবারো দেখা হবে।
স/এষ্