স্বপন দাস, আগৈলঝাড়া (বরিশাল)
আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ১৯২১ সালের ২৮ শে মার্চ (বাংলা ১৩২৭ সনের ২৭ চৈত্র) বরিশাল জেলার তৎকালীন গৌরনদী উপজেলার (বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার) সেরাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম খালেক সন্যামত, মাতা মরহুমা মোসাম্মৎ ফকুরুনন্নেসা বেগম। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেজো বোনের স্বামী। তিনি গৈলা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় (বরিশাল জেলার বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়) থেকে ১৯৩৯ সালে সরকারি বৃত্তিসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৪১ সালে সরকারি বৃত্তিসহ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন তিনি। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে মহকুমা বরিশাল মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে মুসলিম লীগের গণবিরোধী ভূমিকার জন্য মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্রী দলে যোগদান করেন। এক পর্যায়ে দলের বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ হন। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারীর পর তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলেও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবীতে গঠিত সর্বদলীয় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে ৬ দফা ঘোষণা করলে তাকে সমর্থন করেন ও স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন ও বরিশালের তৎকালীন গৌরনদী-উজিরপুর আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন ও দক্ষিণাঞ্চলীয় কমিটির প্রশাসক নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে বরিশালের গৌরনদী আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের প্রথম ভূমি মন্ত্রী হন তিনি । এ সময়ে তিনি ভূমি ব্যবস্থা সংস্কার, ৭ বছর মেয়াদী খাই-খালাসি আইন, বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পরিবারের সর্বোচ্চ একশত বিঘা জমি সংরক্ষণের সিলিং নির্ধারণ করা, ভূমিহীনদের মধ্যে সরকারি খাস জমি বিতরণ করা সহ যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত কৃষি ও ভূমি সংস্কার, বিদুৎ ও পানি উন্নয়ন, মৎস ও পশু সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং বরিশাল জেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম সদস্য ছিলেন। তিনি বরিশালের আইনজীবী ছিলেন। রাজনীতি ও আইন পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করতেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত। তিনি ইউপিআ’র বরিশাল প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি মফস্বল সাংবাদিকদের সংগঠন সাংবাদিক সমিতির বরিশাল শাখার সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে গঠিত “প্রান্তিক” এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত । তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এদেশের কৃষকদের মুক্তির লক্ষ্যে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঢাকার ২৭ নম্বর মিন্টো রোডে অবস্থিত তার বাসভবনে বসে সামরিক বাহিনীর মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা, ক্যাপ্টেন মাজেদ সহ কতিপয় ঘাতকের হাতে আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে নিহত হন। ওই সময় ওই বাসভবনে বসে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর মেয়ে বেবি সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শহিদ সেরনিয়াবাত, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর পুত্র আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র শিশু সন্তান সুকান্ত আব্দুল্লাহ কে মায়ের চোখের সামনে হত্যা করে ঘাতকচক্র। সে সময় অন্যদের সাথে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর স্ত্রী জখম হন। কিন্তু আল্লাহ্ এর অশেষ রহমতে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর পুত্র আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রীর গায়ে গুলি লাগা সত্বেও প্রাণে বেঁচে যায়।
স/এষ্